নিখরচায় ওষুধ দেওয়ার সরকারি প্রতিশ্রুতি এবং নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু সরকার যদি সময়মতো টাকাটাই না দেয়, তা হলে সেই প্রতিশ্রুতি পালন হবে কী ভাবে? কয়েক মাস পরপরই আর জি কর, নীলরতন বা কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের মতো এ শহরের একাধিক প্রথম সারির হাসপাতালের টাকার ভাঁড়ার শূন্য হয়ে যাচ্ছে। ওষুধ কেনা যাচ্ছে না। সমস্ত ওষুধ নিখরচায় দেওয়ার আর্থিক বোঝাও কম নয়। অতএব, ‘ধারকর্জ’ করে চালানোর পথই ধরেছে স্বাস্থ্য ভবন।
এ হল ‘পারস্পরিক ধার’। এক স্বাস্থ্যকর্তার কথায়, ‘‘অভাবের সংসারে এই ভাবেই চালাতে হবে।’’ পরীক্ষামূলক ভাবে চলতি মাস থেকেই এর প্রয়োগ শুরু হয়েছে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে।
প্রক্রিয়াটি কী রকম?
স্বাস্থ্য ভবন সূত্রের খবর, রাজ্যের কোনও মেডিক্যাল কলেজে হয়তো ঠিক সময়ে টাকা ঢুকে গিয়েছে। অথচ, তারা খরচ করতে পারছে না। তখন যে মেডিক্যাল কলেজে অনেক দিন ধরে টাকা আসছে না, তাদের জন্য প্রথম মেডিক্যাল কলেজটি প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনে দেবে বা ধারে ওষুধ বিক্রি করবে। পরে টাকা ঢুকলে দ্বিতীয় মেডিক্যাল কলেজটি তা শোধ করবে। আবার, কোনও মেডিক্যাল কলেজে উদ্বৃত্ত ওষুধ থাকলে তারা সেই ওষুধ অন্য মেডিক্যাল কলেজকে ধারে বিক্রি করে দেবে।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে যেমন প্রতি মাসে ওষুধের জন্য ন্যূনতম তিন কোটি টাকা লাগে। গত দেড় মাস ধরেই তাদের টাকার আকাল চলছিল। গত ১০ ডিসেম্বর থেকে ওষুধ কেনার টাকার ভাণ্ডার একেবারে শূন্য হয়ে গিয়েছে। স্বাস্থ্য ভবনকে তা বারবার জানানোর পরে স্বাস্থ্যকর্তারা খোঁজ নিয়ে দেখেন, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যথেষ্ট টাকা রয়েছে এবং তাঁদের ভাঁড়ারে হৃদ্রোগের একটি দামি ওষুধ অনেকগুলি পড়ে রয়েছে, যার এক্সপায়ারি ডেট ২০১৮ সালের মার্চ মাসে। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে আবার সেই ওষুধের প্রয়োজন। তখন স্বাস্থ্য ভবনের নির্দেশেই অনলাইনে ওষুধের বরাত দেয় মেডিক্যাল। সেই ওষুধ তাদের সরবরাহ করে ন্যাশনাল মেডিক্যাল। টাকা মেটানো হবে পরে।
মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত বহু মানুষ নিয়মিত ওষুধ নেন। হাসপাতাল সূত্রের খবর, প্রতি মাসে ওই হাসপাতালে প্রায় চার হাজার ভায়াল ইনস্যুলিন লাগে। টাকার অভাবে তা কেনা যাচ্ছে না। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের উদ্বৃত্ত ২৫০ ভায়াল ইনস্যুলিন ধারে বিক্রি করা হয়েছে মেডিক্যালকে। একই ভাবে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ থেকে মৃগী রোগের প্রায় ৫০ হাজার ওষুধ দু’-এক দিন আগেই কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ধারে কিনেছে। টাকা পরে শোধ করবে।
টাকাশূন্য কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয় ফ্যাক্টর-৮ প্রায় ৫০ ভায়াল, আর্থ্রাইটিসের ওষুধ প্রায় ১৩ ভায়াল এবং ইনস্যুলিন প্রায় ২০০ ভায়াল ধারে কিনেছে মেদিনীপুরের থেকে। এক স্বাস্থ্যকর্তার কথায়, ‘‘মেদিনীপুরের ভাঁড়ারে তিন কোটি টাকা ছিল। তার উপরে আরও তিন কোটি ২৭ লক্ষ টাকা ঢুকেছে। ফলে তারা অন্য মেডিক্যাল কলেজকে কিছু ওষুধ ধারে বিক্রি করতেই পারে।’’ যে ওষুধগুলি মেডিক্যাল ধারে কিনেছে, সেগুলি খুব দামি। যেমন, আর্থ্রাইটিসের ওষুধ। একটি ভায়ালের দাম ১৩-১৪ হাজার টাকা। ইনস্যুলিনের এক-একটি ভায়ালের দাম পাঁচ-ছয় হাজার টাকা আর ফ্যাক্টর ৮-এর দাম পরিমাণ অনুযায়ী ৩-১৫ হাজার টাকার মতো।
আর জি করেও ওষুধ কেনার টাকার শোচনীয় হাল। চলতি সপ্তাহ শুরু হয়েছিল ভাঁড়ারে এক কোটি টাকা নিয়ে। জরুরি ভিত্তিতে ৮৯ হাজার টাকা দিয়ে কোলন ক্যানসারের পাঁচটি ভায়াল কেনার পরে ৩০ ডিসেম্বর মেরেকেটে ভাঁড়ারে রয়েছে ৯-১০ হাজার টাকা। টাকার অভাবে ২৯ ডিসেম্বর সেখানকার ডায়াবেটিক ক্লিনিক থেকে কাউকে ইনস্যুলিন দেওয়া যায়নি। ওই ক্লিনিকে দৈনিক প্রায় ১২০০ রোগী আসেন। তাঁদের অন্তত অর্ধেকের ইনস্যুলিন লাগে। আবার নীলরতনের ওষুধ কেনার দু’টি ‘হেড’-এর একটিতে ‘নেগেটিভ ব্যালান্স’ হয়ে গিয়েছে। অন্যটিতে মেরেকেটে দু’-তিন লাখ টাকা রয়েছে, যা যে কোনও মুহূর্তে শেষ হয়ে যাবে। স্বাস্থ্য ভবনই জানিয়েছে, নীলরতনে মূলত রক্তের ক্যানসারের বহু রোগীকে ওষুধ দেওয়া যাচ্ছে না।