প্রতিমার একঢাল কোঁকড়ানো চুলের স্রষ্টা ওঁরা। ষাট বছরের বেশি সময় ধরে সে কাজে যুক্ত থাকার পরেও অবশ্য কোনও সম্প্রীতির উদাহরণ হওয়ার দাবি করছেন না তাঁরা। উপরন্তু নির্দ্বিধায় বলে ওঠেন― ও সব বড় বড় কথা বুঝি না। মিরপুরের আমরা কয়েক ঘর মুসলমান এটা আঁকড়েই বেঁচে আছি। এ কাজ আমাদের মুখে ভাত যোগায়।
ওঁদের এই প্রচারবিমুখ মনোভাবের জন্যই দক্ষিণ ২৪ পরগনার এনায়েতনগর গ্রাম পঞ্চায়েতের এক গ্রামের এমন কর্মযজ্ঞ সে ভাবে কারও নজর টানেনি। তাই কাছাকাছি পৌঁছেও মিরপুরের সুলুক সন্ধান পেতে স্থানীয়দের সাহায্য নিতে হল। গ্রামের রাস্তার ধারে বাঁশের খুঁটিতে থরে থরে ঝোলানো কালো রঙের বিনুনি। এক ঝলক দেখে চুল বলে ভুল হতে পারে। আসলে এগুলো পাট দিয়ে তৈরি চুল যা বিশেষ প্রক্রিয়ায় কোঁচকানো হয় বলে স্থানীয়দের মুখে ‘ক্রেপ’ ব্যবসা নামে পরিচিত।
তল্লাটে ঢুকলে মনে হবে গোটা গ্রামটাই একটা ‘পার্লার’। কোথাও চলছে পাটের দু’প্রান্ত কেটে মাঝের অংশ সংগ্রহের কাজ। কোথাও আবার তা কালো রঙে ডুবিয়ে রাখা হচ্ছে বড় বড় সিমেন্টের গামলায়। ইসমাইল নামে এক কর্মী জানালেন, এ ভাবে ঘণ্টা তিনেক থাকবে। জল থেকে তুলে রোদে দেওয়া হবে। দু’দিন ধরে সে সব শুকোনোর পরে বিশেষ পদ্ধতিতে তা আঁচড়ানো হবে। সেই চুল দিয়ে বিনুনি তৈরি করতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে চণ্ডী, কৃপারামপুর, সামালির মতো এলাকায়। মূলত হিন্দু পরিবারের মেয়েরাই সে কাজ করেন। সেই বিনুনি কালো জলে ডোবানো হয়। ভেজা বিনুনি রোদে শুকোনো হয় আরও দু’-তিন দিন। এর পরে মোড়কবন্দি করা হয় চুল। ২০০ গ্রামের প্যাকেটের দাম হয় ৪০ টাকার আশপাশে। শিব আর অসুরের জন্য লাল আর বাদামি রঙের চুলও তৈরি করেন ওঁরা।
গ্রামেরই বাসিন্দা কুতবুদ্দিন মির্জার কথায়, ২০ ঘরের বেশি মুসলমান পরিবার এই ব্যবসায় যুক্ত। সারা বছর ধরে শুধু প্রতিমার চুল তৈরি করেই এতগুলো জীবন চলে। আর কোথাও তৈরিও হয় না এই চুল। কুমোরটুলি ছাড়া তা যায় রাজ্যের অন্যত্র, এমনকি ভিন্ রাজ্যেও।
এই চুলের স্রষ্টা বার্শেদ আলি শেখ মারা গিয়েছেন বছর তিরিশেক আগে। কিন্তু তাঁর দেখানো পথ আজও মনে রেখেছে এই গ্রাম। কুমোরটুলিও। সেই সময়ে কুমোরটুলির প্রতিমা শিল্পীদের বড় মাথাব্যথা ছিল প্রতিমার চুল নিয়ে। লম্বা পাটকে রং করে কাঠিতে পাকিয়ে প্রতিমার চুল হত বটে। তবে ছোট প্রতিমার চুল, সিঁথি এবং সামনের ঢেউ খেলানো চুলের ফর্মূলা তখনও অধরা ছিল। সেই রহস্যই ভেদ করেছিলেন আলি সাহেব।
আব্বার সেই সাফল্য শোনাতে গিয়ে চোখ চিকচিক করে ওঠে আশরাফ আলি শেখের। আব্বা তখন সত্যিকারের চুল দিয়ে বিনুনি বানিয়ে পরচুল করতেন। সেই পদ্ধতির সঙ্গে আরও কিছু যোগ করে প্রথমে পাঁচ কিলোগ্রাম পাট দিয়ে পরীক্ষামূলক শুরু করেছিলেন। আব্বার কাছে শুনেছিলাম, খুব প্রশংসা করেছিলেন রাখালচন্দ্র রুদ্র পাল আর মোহনবাঁশি রুদ্র পাল। তখন সোনার ভরি ছিল ৩০০ টাকারও কম। বাবাকে আগাম পঁচিশ হাজার টাকা দিয়ে ওই চুল তৈরির বরাত দিয়েছিলেন। শর্ত ছিল, কাউকে দেওয়া যাবে না।― বললেন বৃদ্ধ আশরাফ সাহেব।
শিল্পী সনাতন রুদ্র পালের স্মৃতিতে এখনও স্পষ্ট আলি সাহেব। “ওঁর ছেলে রাজুভাইয়ের (আশরাফ) সঙ্গে এখনও ব্যবসা করছি। হাওড়ার পার্বতীপুরের পাটের চুল লম্বা হয়, কোঁচকানো নয়। ওই চুল বড় প্রতিমার জন্য ঠিক আছে। কিন্তু ছোট প্রতিমা, ছাঁচের ঠাকুর, বড় শিব, কার্তিক, বিশ্বকর্মা, অসুরের কেশসজ্জায় তা ব্যবহার করা যায় না। সে জন্য মিরপুরের চুলই ভরসা।’’