৮০ হাজার দিলেই খুলে দেবে স্কুল, তার পর দেদার ব্যবসা

প্রতিটি ঘর, বারান্দায় জ্বলছে টিউবলাইট। কাঠের পার্টিশন দেওয়া সরু বারান্দায় পর পর খুপরি। একটি খুপরিতে চলছে টিভি। অন্য খুপরিতে আবার প্রেশার কুকারে রান্না হচ্ছে।

Advertisement

সুপ্রিয় তরফদার, আর্যভট্ট খান

শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৮ ০৪:৪৬
Share:

প্রতীকী ছবি।

দিনের বেলাতেও সূর্যের আলো ঢোকে না। তাই প্রতিটি ঘর, বারান্দায় জ্বলছে টিউবলাইট। কাঠের পার্টিশন দেওয়া সরু বারান্দায় পর পর খুপরি। একটি খুপরিতে চলছে টিভি। অন্য খুপরিতে আবার প্রেশার কুকারে রান্না হচ্ছে। কোনও ঘরে সমস্বরে শিশুস্বর, ‘‘জনি জনি, ইয়েস পাপা/ ইটিং সুগার নো পাপা।’’

Advertisement

সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ে গিরিশ পার্কের কাছে তিনতলা বসতবাড়িতে এ ভাবেই চলছে ‘প্রি’ অর্থাৎ প্রাক-প্রাথমিক স্কুল। অপরিসর গেট দিয়ে ঢোকার পরে বাড়ির কোন অংশটা স্কুল আর কোনটা বসতবাড়ি, গুলিয়ে যায়। বাগুইআটি এলাকায় আবার কিছু দিন আগে পর্যন্ত অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া দেওয়া বাড়িতে রাতারাতি খোলা হয়েছে প্রি-স্কুল।

শুধু এই দু’টি নয়, কলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা প্লে ও প্রি স্কুলগুলোতে ঘুরলে দেখা যাচ্ছে, কয়েকটি বাদে অনেক স্কুলের পরিকাঠামো কার্যত কিছুই নেই। বিয়েবাড়ি, বসতবাড়ি, বড়সড় গুদাম ঘর, গ্যারাজকেই বদলে দেওয়া হয়েছে প্রি-স্কুলে। আড়াই থেকে পাঁচ বছরের শিশুরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাচ্ছে সেখানেই। সে জন্য যথেষ্ট মূল্যও দিতে হচ্ছে। বেশির ভাগ ইংরেজি মাধ্যম প্রি-স্কুলে অ্যাডমিশন ফি ১৫-২০ হাজার। মাসিক বেতন কোনও স্কুলেই ১৪০০ টাকার কম নয়। অথচ পরিকাঠামো?

Advertisement

আরও পড়ুন: দুটি পৃথক ঘটনায় আগুনে ছাই ২ কারখানা

শিক্ষাবিদদের মতে, প্রি-স্কুলে খোলামেলা ক্লাসরুম, আলাদা করে চারদিক খোলা খেলার জায়গা, লাইব্রেরি, পরিস্রুত পানীয় জলের ব্যবস্থা, পরিষ্কার শৌচাগার, সিসিটিভি, নানা ধরনের খেলনা, ফার্স্ট এড বক্স, অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা থাকা অবশ্যই জরুরি। কিন্তু অভিযোগ, বেশির ভাগ স্কুলে নামমাত্র অগ্নি নির্বাপণ যন্ত্র ঝুলিয়ে রাখা ছাড়া আর কোনও পরিকাঠামো নেই।

টালিগঞ্জ এলাকার এক অভিভাবক কিংশুক মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বাচ্চাদের স্কুলে পাঠিয়ে খুবই ভয় করে। ২০০৪ সালে তামিলনাড়ুর কুম্ভকোনমের প্রাইমারি স্কুলে রান্নাঘর থেকে আগুন ছড়িয়ে ৯৪টি বাচ্চা মারা গিয়েছিল। তার পরেও তো কারও হুঁশ ফেরেনি।’’

প্রি-স্কুল ফি

ইংরেজি মাধ্যম

ভর্তি ফি
১৮০০০ থেকে
২২০০০ টাকা

মাসিক বেতন
১৪০০ থেকে ১৬০০ টাকা

ভর্তি ফি-র মধ্যে স্কুলের বই, ব্যাগ, স্কুলের পোশাক, জুতো, পরীক্ষার ফি, মক ইন্টারভিউ ফি, ডক্টর অন কল ফি অন্তর্ভুক্ত
কোনও কোনও স্কুলে পোশাক, জুতো, ব্যাগ অন্তর্ভুক্ত নয়

বাংলা মাধ্যম

ভর্তি ফি
৪০০০ থেকে
৫০০০ টাকা

মাসিক বেতন
৪৫০ থেকে ৬০০ টাকা

কোনও কিছুই অন্তর্ভুক্ত নয়

যাঁদের হুঁশ থাকার কথা, তাঁদের অধিকাংশই অবশ্য স্কুলের পরিকাঠামো সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গিয়েছেন। বাগুইআটি এলাকা়র একটি প্রি-স্কুলের শিক্ষিকা সোমা ঘোষ বলেন, ‘‘আমাদের স্কুল চলছে ভাড়া বাড়িতে। ভাড়া বাড়িতে তো সব কিছু পাল্টে ফেলা যায় না। তার মধ্যেই যতটা পারা যায়, পরিকাঠামো ঠিক রাখার চেষ্টা করি।’’ গিরিশ পার্কের কাছে প্রি-স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার দাবি ‘‘পরিকাঠামোয় খামতি কিছু আছে। তবে বাচ্চাদের নিরাপত্তায় সব থেকে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।’’
খুপরি ঘর, সরু বারান্দা আর পাশের ঘরেই রান্না —এর মধ্যে নিরাপত্তা কী ভাবে দেওয়া সম্ভব, তার সদুত্তর অবশ্য মেলেনি।
সদুত্তর পাওয়ার কথাও নয়। কারণ, স্রেফ ট্রেড লাইসেন্স ও দমকলের ‘নো অবজেকশন’ সার্টিফিকেট থাকলেই খুলে ফেলা যায় প্রি-স্কুল। আর কোনও কর্তৃপক্ষের অনুমতি বা অনুমোদনের প্রয়োজনই হয় না বলে দাবি বিভিন্ন প্রি-স্কুলের কর্তৃপক্ষের। সে কারণে কলকাতার মাঝেরহাট এলাকায় একটি সংস্থা ঢালাও বিজ্ঞাপন দিয়েছে —কেউ প্রি-স্কুলের ‘ব্যবসা’ করতে চাইলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।

কী ভাবে মেলে ফায়ার সেফটি সার্টিফিকেট কী কী দেখা হয় স্কুলের সামনে দমকলের গাড়ি আসতে পারবে কি না অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র আছে কি না কী কী দেখা হয় না স্কুলের পরিকাঠামো( ক্লাস ঘরের আয়তন, সিঁড়ি, খেলার জায়গা ঠিক মতো আছে কি না) নিয়মিত নজরদারি কেন সম্ভব নয় ‘‘প্রতিটি প্রি-স্কুলে গিয়ে নিয়মিত নজরদারি চালানোর পরিকাঠামো কার্যত নেই,’’ মন্তব্য এক দমকল কর্তার


‘প্রাইভেট টিউটর’ পরিচয় দিয়ে ওই নম্বরে ফোন করা হলে সংস্থার এক কর্মী বলেন, ‘‘জায়গা ও ঘর কি আপনার? তা হলে ৮০ হাজার টাকা দিলেই প্রি-স্কুলের ব্যবসা করা যাবে।’’ ব্যবসা? উত্তর এল, ‘‘আপনি পড়ান, তাই আপনার শুনতে খারাপ লাগছে। কিন্তু আসলে অনেকের কাছেই এটা স্রেফ ব্যবসা। নিয়ম-কানুন তো পরের কথা।’’ ফলে যিনি যেমন ভাবে পারেন, তিনি তেমন ভাবেই প্রি-স্কুল চালাচ্ছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন