পার্ক স্ট্রিটে গাড়ি থামিয়ে চলছে ব্রেথ অ্যানালাইজার দিয়ে পরীক্ষা।
রাত ১১টা ২৫। ইএম বাইপাসের ভিআইপি বাজার মোড়ের পানশালাগুলিতে শনিবারের রাত তখন জমে উঠেছে। একটি পানশালার ভিতরে বসেছে নাচ-গানের আসর। একদল যুবকের পার্টি তখন শেষের পথে। পানশালার কর্মীকে টিপ্স দিয়ে টলমলে পায়ে হইহই করে উঠে পড়ল দলটি।
কী ভাবে বাড়ি ফিরবেন ওঁরা?
অ্যাপ-ক্যাব ডাকা অথবা অন্য ভাবে তাঁদের সাহায্য করার জন্য পানশালায় কোনও পরিকাঠামো আছে কি? পানশালা থেকে বেরিয়ে যাওয়া হল যুবকদের পিছু পিছু। বাইরে তখন গাড়ির ভিড়। সেখানেই রাখা একটি কালো এসইউভি-তে উঠে পড়ল দলটি। এক জন বসলেন স্টিয়ারিংয়ে। যিনি গাড়ি চালাবেন তিনিও যে রয়েছেন মত্ত অবস্থায়, দূর থেকেও অসুবিধে হয় না বুঝতে। গাড়ি চলতে শুরু করল রুবির দিকে।
যাওয়া গেল সেই এসইউভি-র পিছন পিছন।
রুবি মোড়ে তখন লালবাতি। সেই বাতি সবুজ হতে না হতেই দ্বিগুণ হল কালো এসইউভি-র গতি। রুবি মোড় থেকে ঘুরে আনন্দপুরের দিকের নির্জন রাস্তায় সেই এসইউভি তখন যেন রেসিং কার। ওই উদ্দাম গতির পিছু নেওয়া তখন কার্যত অসম্ভব ।
পানশালা থেকে বেরিয়ে মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো যাবে না কোনও ভাবেই— পরপর কিছু দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে বছর খানেক আগে এমনই নির্দেশ দিয়েছিল পুলিশ। প্রশাসনের নজরদারি থাকবে রাত পথে, দাবি করা হয়েছিল তেমনই। হোটেল অ্যান্ড রেস্তরাঁ অ্যাসোসিয়েশন অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্ট সুদেশ পোদ্দার দাবি করেছিলেন, বেশির ভাগ পানশালায় অ্যাপ-ক্যাবের কিয়স্ক রয়েছে। ম্যানেজারেরা দরকার হলে সব ধরনের সাহায্য করবেন ক্রেতাদের। কিন্তু খাতায়-কলমে নানা বন্দোবস্ত থাকলেও বাস্তব পরিস্থিতিটা যে এক রকম নয়, শনিবার রাতের শহরই তা ফের দেখিয়ে দিল।.
মধ্য কলকাতায় পানশালা থেকে বেরিয়ে মাঝরাস্তায় হুল্লোড়। শনিবার। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য
রাত ১২টা বেজে ৫ মিনিট। থিয়েটার রোড ও রডন স্ট্রিটের মোড়ের কাছে একটি পানশালার সামনের ছবিটাও বাইপাসের মতোই। পানশালার সামনে পরপর গাড়ি দাঁড়িয়ে। কোথাও পুলিশের দেখা নেই। পানশালায় বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে সোজা চালকের আসনে সঙ্গিনীকে নিয়ে বসলেন এক যুবক। ঠিক সোজা নয়, রীতিমতো ধরাধরি করেই তাঁকে স্টিয়ারিংয়ে বসিয়ে দিলেন পানশালার পার্কিং লটের এক কর্মী। গাড়ি ছুটে চলল পার্ক স্ট্রিটের দিকে। ওই কর্মীই বা ও ভাবে যেতে দিলেন কেন যুবককে? কর্মীর উত্তর, “প্রতি সপ্তাহান্তে তো এই ভাবেই গাড়ি চালান উনি। কিছু তো হয় না! আর এখানে অ্যাপ-ক্যাব পাওয়া কঠিন। আমাদের পানশালার কয়েক জন চালক ছুটিতে আছেন।”
রাত ১২টা ২০। পার্ক স্ট্রিটের পানশালার সামনের চেহারাটা অবশ্য অনেকটাই আলাদা। রাস্তায় পুলিশ দাঁড়িয়ে ব্রেথ অ্যানালাইজার নিয়ে। গাড়িচালক মদ্যপান করেছেন কি না, দেখতে চলছে পরীক্ষা। পাশ করতে না পারলে জরিমানা হচ্ছে। তবে জরিমানা দেওয়ার পরে ওই মত্ত চালকই ফের স্টিয়ারিংয়ে বসছেন। এক কর্তব্যরত পুলিশ শুধু সাবধান করছেন, “পরের বার এত খেলে গাড়ির চালক নিয়ে আসবেন।” পার্ক স্ট্রিট থানার ওই কর্তব্যরত পুলিশ বলেন, “আমরা প্রতিদিনই এই ভাবে চেকিং করি।”
তবে পুলিশি নজরদারি থেমে গেল রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ। অ্যালেন পার্ক মোড়ে যেখানে পুলিশ দাড়িয়ে নজর রাখছিল, সেখান দিয়েই তখন উদ্দাম গতিতে যাচ্ছে পানশালা থেকে বেরোনো গাড়িগুলি।
রাত ১২টা ৪৫। ভবানীপুরের একটি পানশালার ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেলেও সামনে মোটরবাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন দুই যুবক। তাঁরা যে পানশালা থেকে বেরিয়েছেন, তা দেখলেই বোঝা যায়। কেন এত রাতে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁরা? উত্তর এল, বাইক নিয়ে আর এক দল বন্ধু আসবে অন্য একটি পানশালা থেকে। তার পরে একসঙ্গে বাড়ি ফেরা। তবে বাড়ি ফেরা মানে যে দুই দল যুবকের মধ্যে মোটরবাইকে রেস, তা মালুম হল মিনিট পাঁচেকে। উদ্দাম গতিতে ছুটল এক ঝাঁক বাইক। রাস্তার পাশে দাঁড়ানো পুলিশের ভ্যান তখন নির্বাক দর্শক। নিমেষে গতির ঝড়ে অদৃশ্য হল দলটি।
রাত ১টা বেজে ৫ মিনিট। চাঁদনি চক অঞ্চলের পানশালা বন্ধ হয়ে গেলেও অর্ধেক শাটার উঠিয়ে কয়েক জন বেরোচ্ছিলেন। নিজেদের গাড়ি ছিল না সঙ্গে। সামনে দাঁড়ানো কয়েকটা হলুদ ট্যাক্সি হাঁকা ভাড়ায় রাজি হতে পারলেন না যুবকেরা। দেখা নেই অ্যাপ-ক্যাবেরও। পানশালা থেকে গাড়ি ডেকে দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। সাহায্যের হাত বাড়াতে গোটা তল্লাটে নেই কোনও পুলিশ। এক যুবক বলেন, “মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালাব না ভেবেছিলাম। কিন্তু যা পরিস্থিতি, তাতে পরের সপ্তাহ থেকে গাড়ি
নিয়েই আসব।”
ডিসি (এসএসডি) সন্তোষ নিম্বলকর দাবি করেছিলেন, “ইস্টার্ন বাইপাস লাগোয়া প্রতিটি পানশালার সামনেই চলে পুলিশের নজরদারি। কোনও ভাবেই মত্ত গাড়ি চালকের হাতে স্টিয়ারিং যেন না থাকে, সে দিকে কড়া নজর দেওয়া হয়।” কিন্তু রাতভর মহানগরের রাজপথে ঘুরে ঘুরে দেখা গেল, ছবিটি একেবারেই অন্য।
ডিসি (দক্ষিণ) মিরাজ খালিদ বলছেন, ‘‘মত্ত অবস্থায় বার থেকে বেরিয়ে গাড়ি চালানো আমরা কোনও ভাবেই বরদাস্ত করি না। প্রতিদিনই পানশালাগুলির সামনে পুলিশ থাকে। প্রচুর কেসও দেওয়া হচ্ছে। আগের থেকে সমস্যা অনেক কমেছে। পানশালার মালিকদেরও সতর্ক থাকতে বলা হচ্ছে।’’ গোটা পরিস্থিতি শুনে সুদেশবাবু রবিবার বলেন, ‘‘আমরা এই নিয়ে নোটিস দিয়েছিলাম। তবু কেউ যদি না মানে, তা হলে ফের নোটিস দেব। অ্যাপ-ক্যাবের আলাদা কাউন্টার করতেও অনুরোধ করা হবে।’’