‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস’ উপলক্ষে প্রদর্শনী। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলে। ছবি:শুভাশিস ভট্টাচার্য।
ছেলের বয়স যখন দু’বছর, তখন পরিবারের লোকজন খেয়াল করলেন, সে কোনও কথাই বলতে পারছে না। অথচ ওর বয়সী অন্য বাচ্চারা এর মধ্যেই ‘বাবা-মা-দাদা’ ডাকছে। কেউ কেউ তো আবার ছোট ছোট শব্দে বকবকও করে যায় সমানে। কিন্তু এ ছেলে তো কেমন চুপচাপ তাকিয়ে থাকে। কথা বলা তো দূর। ফলে দু’বছরের ছেলেকে নিয়ে বেশ চিন্তাতেই পড়ে গিয়েছিলেন মা ঋতুপর্ণা সরকার। এরই মধ্যে কেউ বলেছিল ‘স্পিচ থেরাপি’ করাতে, আবার কেউ ‘হিয়ারিং টেস্ট’ করাতে। কোনওটাই বাদ দেননি। কিন্তু তাতেও লাভ হল না। শেষে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যান ছেলেকে। আর তখনই জানতে পারেন তাঁর ছেলে ‘অটিস্টিক স্পেকট্রাম সিনড্রোমের’ শিকার।’
প্রায় একই সমস্যায় পড়েছিলেন আর এক মা, শ্রাবণী চক্রবর্তী। ছেলে কোনও কথা বলতে পারছিল না। অথচ মাঝেমাঝেই কেঁদে উঠত। আর শ্রাবণীদেবী ভাবতেন ছেলের পেটে ব্যথা হচ্ছে কিংবা কোনও সমস্যা হচ্ছে। ফলে ছেলে কেঁদে উঠলেই তিনি পেটে ব্যথা কমানোর ওষুধ খাইয়ে দিতেন। কিন্তু তাতেও ছেলের কান্না থামত না। এর পরে যা হয়। আত্মীয়দের কেউ মন্দিরে, কেউ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিতে শুরু করলেন। আবার কেউ উপদেশ দিয়েছিলেন, ‘‘কোনও সমস্যাই নয়। অনেকেই একটু বেশি বয়সে কথা বলতে শেখে।’ কিন্তু তাতেও বাবা-মা নিশ্চিন্ত হতে পারছিলেন না। এমন সময়েই পরিচয় হয় ‘অটিস্টিক সিনড্রোমের’ শিকার এক শিশুর মায়ের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে কথা বলার পরে সেই মহিলাই শ্রাবণীদেবীকে বলেন ছেলের অটিজিম রয়েছে কি না, পরীক্ষা করাতে।
সেটা কী এমন অসুখ? ইন্টারনেট ঘেঁটে, বই পড়ে সাধারণ কিছু তথ্য তো পাওয়া গেল। কিন্তু তার ভিত্তিতে সন্তানকে ‘স্বাভাবিক’ করবেন কী করে? তার কী দরকার, সে কী চাইছে— এ সব বুঝবেন কী করে? কারণ এ ধরনের বাচ্চা মানেই তো নিজের ইচ্ছে প্রকাশ করতে না পারার সমস্যায় ভোগা। আর তার ফলে রেগে যাওয়া, চিৎকার-চেঁচামেচি করে জিনিস ছোড়াছুড়ি!
কিন্তু ঠিক সময়ে চিকিৎসা এবং কাউন্সেলিং শুরু করলে এ ধরনের বাচ্চাদের সমস্যা অনেকটা দূর করা যায় বলেই মত চিকিৎসকদের। মনোবিদ জয়রঞ্জন রামের কথায়, ‘‘অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের কাছেই এই সব বাচ্চারা অবহেলিত হয়। সবের আগে পরিবারের লোক জনকে এই রোগ সম্পর্কে সচেতন ও সহিষ্ণু হতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে সমাজের মধ্যেও সচেতনতা বাড়াতে সরকারি-বেসরকারি ভাবে প্রচার বাড়ানো দরকার।’’ তিনি আরও জানান, এরা পুরোপুরি সুস্থ না হলেও এদের জীবনের মান অনেকটাই উন্নত করা যায় চিকিৎসা
ও সহিষ্ণুতায়।
ঋতুপর্ণাদেবী এবং শ্রাবণীদেবী এর পরে যোগাযোগ করেন ‘অটিজিম সোসাইটি অব ওয়েস্ট বেঙ্গল’ (এএসডব্লিউবি)-এর সঙ্গে। কিন্তু সেখানে গিয়েও প্রথম পুরো বিষয়টা ধরতে পারেননি তাঁরা। কিন্তু সমস্যার সমাধান তো করতে হবে। তাই নিজেরাই এই সংস্থায় গিয়ে বিষয়টি বোঝার সঙ্গে সমাধানের উপায় কী হতে পারে, তা শিখতে শুরু করেন। বুঝতে পারেন, তাঁদের ছেলেরা মস্তিষ্কের কিছু সমস্যার কারণেই অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে না। শুধু তাঁরা দু’জন নয়, বহু পরিবারই এ ধরনের সমস্যার সঙ্গে লড়ছে। ঋতুপর্ণাদেবীর কথায়, ‘‘এর পরেই এএসডব্লিউবি-র সঙ্গে যোগাযোগ করে ছেলেকেও নিয়ে এলাম। নিজেও প্রশিক্ষণ নিলাম, কী করে এ ধরনের সমস্যা সামলাতে হয়।’’ এর পরে নিজের মতো করে ছেলেকে বুঝে, তার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন। এখন তাঁর ছেলে কথা বলতে না পারলেও বিভিন্ন জিনিস দেখিয়ে নিজের ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারে। একই ভাবে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারে।
শ্রাবণীদেবীর ছেলের বয়স এখন প্রায় সাড়ে সাত। সে-ও কথা বলতে পারে না। কিন্তু ছবি দেখিয়ে কিংবা মোবাইলের এক বিশেষ অ্যাপের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেয় তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা। রবিবার এএসডব্লিউবি-র অনুষ্ঠানে এসে অটিস্টিক সিনড্রোমের শিকার হওয়া সত্ত্বেও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক কিংবা সমাজের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উপায়ের কাহিনি শুনিয়ে এ ভাবেই একাধিক বাবা-মা জানান দিলেন, এ ধরনের সমস্যার সমাধান ছেলেমেয়েদের দূরে ঠেলা নয়। তাদের বুঝে নিয়ে তাদের সঙ্গে মিশতে পারলেই জীবন সহজ
হয়ে উঠবে।