নামের চমকেই মেলে দোকানের পরিচয়

মাখনলালবাবু মারা গিয়েছেন। তবে গৌরীবাড়িতে রয়েছে ওই দোকান। মেজো ছেলে রামকৃষ্ণ কুন্ডুর কাছ থেকে সেই ‘মলিন মোচন’ পরে কিনে নেন রাজদেব রজক নামে এক ব্যক্তি।

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৮ ১৩:৩৫
Share:

নামবাহার: এই রকম অভিনব নামের মাধ্যমেই আত্মপরিচয় ধরে রেখেছে শহরের বিভিন্ন দোকান। ছবি: শৌভিক দে

বিছানা অপরিচ্ছন্ন, এলোমেলো দেখলেই প্রবল চটে যেতেন মাখনলাল কুন্ডু। শেষ জীবনে তাঁর সেই বাতিক এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে, বাড়ির লোকজন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। এক দিন তাঁর মেজো ছেলে মাখনলালবাবুকে জানান, পোশাক ধোলাই এবং ইস্ত্রির দোকান করতে চান। গৌরীবাড়িতে একটি ঘর কেনা হয়েছে। সেখানেই আপাতত কাজ শুরু হচ্ছে। প্রবল খুশি মাখনলালবাবু নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘‘দোকানের নাম দাও, মলিন মোচন!’’

Advertisement

মাখনলালবাবু মারা গিয়েছেন। তবে গৌরীবাড়িতে রয়েছে ওই দোকান। মেজো ছেলে রামকৃষ্ণ কুন্ডুর কাছ থেকে সেই ‘মলিন মোচন’ পরে কিনে নেন রাজদেব রজক নামে এক ব্যক্তি। দোকানের নামকরণের ইতিহাস জানাতে গিয়ে রাজদেব বললেন, ‘‘অনেকেই এসে জানতে চান, নাম কে দিয়েছেন! আমি বাংলা ভাল বুঝি না। নিশ্চয়ই ভাল নাম, তাই সবাই প্রশ্ন করেন।’’

উত্তর থেকে দক্ষিণ— শহর কলকাতায় হামেশাই চোখে পড়ে এই ধরনের নাম! কোথাও সেলুনের গায়ের ব্যানারে নাম হিসেবে লেখা থাকে ‘কেশশ্রী’। কখনও চোখে পড়ে, তিনতলা বাড়ির গায়ে নাচের স্কুলের বিজ্ঞাপন। নাম, ‘পদধ্বনি’। কোথাও আবার খাবারের দোকানের নাম ‘পেটুক’। বাইপাসের ধারে একটি পানশালার নাম ‘দেবদাস’। বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে একটি চায়ের দোকানের নাম রাখা হয়েছে ‘ফালতু’!

Advertisement

সার্ভে পার্কের সন্তোষপুর অ্যাভিনিউয়ে বেশ কিছু দিন ধরেই রমরমিয়ে চলছে সেলুন ‘কাট কপি পেস্ট’। দোকানের কর্মীরা জানাচ্ছেন, চুল কাটাই হোক বা দাড়ি কামানো, সবেতেই নকল করতে হয়। কখনও ক্যাটালগের ছবি দেখে হুবহু চুল কেটে দিতে হয়। কখনও আবার গ্রাহকের মোবাইলে আনা ছবি দেখে কাটতে হয় দাড়ি। এক কর্মীর কথায়, ‘‘সবটাই কপি-পেস্টের ব্যাপার। ও সব শুধু কম্পিউটারেই নয়, আমাদের হাতেও হয়। যেমন বলবেন, কেটে দেব।’’ সন্তোষপুরের ওই সেলুনকে নামে টক্কর দিচ্ছে উত্তর কলকাতার গ্রে-স্ট্রিটের ‘কেশ-শ্রী’। দোকানের মালিক শঙ্কর শীল বললেন, ‘‘আমার দাদু বাংলা পড়াতেন। এই দোকানের নাম তাঁরই দেওয়া। তবে সে দিন আর নেই। ভাল বাংলা নাম হলেও এতে খদ্দের আসেন না। এখনকার ছেলেমেয়েরা আধুনিক নাম চান। সে দিক থেকে আমার দোকান সেকেলে।’’

অরবিন্দ সরণিতে সমীর সাধুখাঁ নামে এক ব্যক্তি তাঁর খাবারের দোকানের নাম রেখেছেন ‘পেটুক’। বললেন, ‘‘খেতে ভালবাসি। ছোটবেলায় দিদা পেটুক বলে রাগাত। নিজের খাবারের দোকান। তাই দিদার দেওয়া নামটাই রাখলাম।’’ বিকল্প নাম হিসেবে ইংরেজিতে ‘পে অ্যান্ড টুক’ লিখবেন বলেও ভাবছিলেন সমীরেরা। দক্ষিণ কলকাতার পূর্ণ দাস রোডে আবার রেস্তরাঁর নাম রাখা হয়েছে ‘সপ্তপদী’। উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেনই রেস্তরাঁর থিম। মালিক রঞ্জন বিশ্বাস বললেন, ‘‘এখানে খাবারের নাম রাখা হয়েছে উত্তম-সুচিত্রার সিনেমার নামে। যেমন, চিংড়ি সবার উপরে, ইলিশ চাওয়া-পাওয়া, কাতলা সাগরিকা। মেনুও সাতটি পদ মিলিয়ে সপ্তপদ।’’

বালিগঞ্জের সুইনহো লেনে একটি রেস্তরাঁর নাম ‘ফিশফিশ’। সেখানকার কর্মীরা জানাচ্ছেন, ফিশ তন্দুর, ফিশ চাইনিজ, ফিশ ইন্ডিয়ান-সহ ‘ফিশফিশ’-এ সবই মাছের পদ। বললেন, ‘‘বিষয় মিলিয়ে রেস্তরাঁর নাম রাখা হয়েছে। নামেই বাজি মাত হবে।’’

নামের এই বৈচিত্র সম্পর্কে সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন বললেন, ‘‘যত ভাবনা-নির্ভর নাম হবে, ততই ভাল। নামই তো সব! নামেই তো যায় আসে।’’ সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় আবার বললেন, ‘‘মাথা খাটিয়ে অভিনব নাম বার করা হচ্ছে, এটাই যথেষ্ট উৎসাহজনক ব্যাপার। ট্র্যাডিশনের বাইরে গিয়ে এই ধরনের নাম ভাবা খুবই ভাল লক্ষণ। এতে রুচি এবং ভাষাজ্ঞান— দুইয়েরই প্রকাশ ঘটে।’’ লেখক অমিত চৌধুরীর কথায়, ‘‘বাঙালি নতুন নাম দিতে ভালবাসে। আদতে কলকাতাকেই নতুন ভাবে তুলে ধরে এই নামগুলি।’’

মধ্য কলকাতার প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটে এমনই একটি ছাপাখানার নাম ‘মলিন প্রেস’। তবে তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে বহু দিন। স্থানীয়েরা বলেন, ‘‘উৎপাদন বন্ধ হলেও নাম মলিন হয়নি মলিন প্রেসের।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন