মেয়েটি তার পোষা কুকুরের মুখে মুখ ঠেকিয়ে যথেচ্ছ চুমু খাচ্ছিল আর বুকে টেনে নিয়ে সে কী আকুলি-বিকুলি আদর! বারবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলছিল, দেখুন এ আমার ছেলে।
ব্যাপারটা আমার আদিখ্যেতা বলে মনে হয়নি। মনে হচ্ছিল, এই জীবনে একটা ফাঁক আছে। একটা ফাঁকা জায়গা, যেটা ওই কুকুরকে দিয়ে ভরাট করার চেষ্টা করছে। কিন্তু পেরে উঠছে না। পোষ্যকে ভালবাসে না কে? সবাই বাসে। কিন্তু যখন তা ‘হাইজিন’ বা স্বাস্থ্যবিধি ডিঙোয়, মাত্রা অতিক্রম করে এবং অতিচারে পৌঁছয়, তখন বুঝতে হবে মেয়েটা কুকুরটাকে এমন অবস্থানে স্থাপিত করতে চাইছে, যা বাস্তবসম্মত নয়। চোদ্দো-পনেরো বছরের বেশি কুকুর বাঁচে না। আয়ু শেষে তাকে বিদায় দিতে হবে, এ-ও সকলের জানা কথা। তবু যদি কেউ কুকুরের শোকে সহমরণে যায়, তবে বলতে হবে, জীবনের ওই ফাঁকটুকু ভরাট করার মতো তার আর কিছু ছিল না। ছিল না, কিন্তু সেটা তার অযোগ্যতা নয়, ভাগ্যও নয়, নিতান্তই মনোভঙ্গি। কারণ কুকুরের আনুগত্য শর্তহীন এবং অবিচল। সে ঝগড়া, প্রতিবাদ, তর্ক কিছুই করে না, তার সঙ্গে ইগো-র সমস্যা হয় না, ডিভোর্স-ও নয়। তাই অনেকে কুকুরকে মানুষের চেয়ে অধিকতর গুরুত্ব দিতে শুরু করে। আর ওইখানেই সে মনের বিপজ্জনক চৌকাঠ ডিঙিয়ে যায়।
দেবযানী দে-র বয়স ৪৬ বছর। পোষ্য কুকুরের দেহান্তে সে শোকে প্রায়োপবেশনে প্রাণত্যাগ করেছে বলে তার ভাই পুলিশের কাছে কবুল করেছে। লোকে মা-বাবা ও পুত্রকন্যার মতো প্রিয়জনকে হারিয়েও যেখানে এত কষ্টকর তিল তিল মৃত্যুকে আবাহন করছে না, সেখানে দেবযানীর এই উৎকট হঠকারী সিদ্ধান্ত কেন? আর তার ওই ধীর-স্থির, বিলম্বিত মৃত্যুর প্রক্রিয়া দিনের পর দিন প্রতিরোধহীন ভাবে প্রত্যক্ষ করে গেলেন তার বাবা আর ভাই। এই সরল গল্পটির নীচে ঘোলা জল রয়েছে বলেই মনে হয়।
তবু এ রকম ঘটনা তেমন বিরলও নয়। মৃতদেহ আটকে রাখার ভয়ঙ্কর হিচককীয় ফিল্ম ‘সাইকো’ আমরা তো দেখেছি। কিন্তু ফিল্মের বাইরে বাস্তব জগতেও এ রকম ঘটনা বড় কম নেই। কিছু অসহায় মানুষের ভালবাসা আছে, যা প্রিয়জনের এতটাই মুখাপেক্ষী যে, মৃত্যুকে বিলম্বিত বা অবিশ্বাস করতে চায়। প্রিয়জনের মৃত্যুকে অস্বীকার করে সে তখন হয়তো নশ্বর, পচনশীল দেহটাকেই আগলে রাখে। দেহ অস্তিত্বের খানিকটা তো বটে।
কিন্তু দে পরিবারের ক্ষেত্রে ভালবাসাটা কি টেনিস বলের মতো এধার ওধারে ঘুরে বেড়িয়েছে? কুকুরের প্রতি দেবযানীর, দেবযানীর প্রতি পার্থর ও তার বাবার? তিন জনই সাইকো? গল্পটা একটু বেসুরো বাজছে যেন!
এখনকার দুনিয়ায় জটিল মানসিকতার শিকার অল্পবিস্তর আমরা সকলেই।
বিজ্ঞান-প্রযুক্তি যত এগোয়, ততই মানুষের মনের মধ্যে কলকব্জার প্রতি আনুগত্য অজান্তে ঢুকে পড়ে। মানুষ একটু একটু করে কল হতে থাকে আর কল-মানুষের সঙ্গে মনুষ্যত্বের একটা লড়াই শুরু হয়। সেই লড়াই এমনই মৃদু ও শব্দহীন যে, লড়াই বলে প্রথমটায় বোঝাই যায় না। যেমন জীবাণু বা ভাইরাসের সংক্রমণ। আর তার ফলেই মানুষের মধ্যে কলকব্জার নির্বিকারত্ব, আবেগহীনতা, ভালবাসাহীনতার প্রকাশ ঘটতে থাকে।
দেবযানীর মৃত্যু, যা ধীরে ধীরে ঘটেছে, তা দেখেও তার দুই প্রিয়জন কোনও ব্যবস্থা নিল না! কাঁদল না! লোক ডাকল না! আবেগ প্রকাশ করল না! কিন্তু খুনির মতো দেহটিকে ঘরের দরজা-জানলা বন্ধ করে আড়াল করে রেখে দিল। খুনি বলাটা ঠিক হল না, কিন্তু চোখের সামনে কেউ আত্মহত্যা করলে তাতে যদি বাধা না দেওয়া হয়, সেটাও বোধহয় অপরাধ।
জানি না, এই পরিবারের সকলেই ক্লেশদায়ক মৃত্যু পছন্দ করে কি না। অরবিন্দবাবুর বয়স সাতাত্তর, যা আত্মহননের উপযুক্ত বয়স নয়। কারণ মানুষ যত বুড়ো হয়, তত মৃত্যুভয় চেপে বসে। তা-ও যদি কেউ আত্মহত্যা করেই, তা হলে গায়ে আগুন লাগানোর মতো ঝঞ্ঝাটে যাবে কেন? বুড়ো বয়সের কিছু নিয়মিত ওষুধই তো হাতের কাছে আছে, যা বেশি ডোজে মেরে দিলেই কাজ হয়ে যায়। যেমন ঘুমের ওষুধ, প্রেশারের ওযুধ।
ঘটনাটা সবে ঘটেছে। আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তবে শোনা যাচ্ছে, ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে পার্থ দে প্ল্যানচেট প্র্যাক্টিস করত। কিন্তু প্ল্যানচেটের জন্য তো মৃতদেহের দরকার হয় না। শুনেছি, তান্ত্রিকদের শব-সাধনায় মৃতদেহ লাগে।
এই অতীব দুঃখজনক ঘটনাটির বিষয়ে পরিবারের একমাত্র জীবিত সদস্য পার্থ যা বলেছে, তা বড্ড নড়বড়ে। মনোবিদেরা তার জটিল মানসিক ব্যাধির কথাই বলছেন। সেটা থাকতেই পারে। এবং সেটা তা হলে পরিবারের তিন জনেরই ছিল। কুকুরের শোকে দেবযানীর প্রায়োপবেশনে মৃত্যু বিনা বাধায়, দুই প্রিয়জনের চোখের সামনে— অতীব অবিশ্বাস্য। মৃতদেহকে খাওয়ানো— ঠিক হজম করা যাচ্ছে না। মৃতদেহ বিনা সংরক্ষণে রেখে দেওয়া— সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। অরবিন্দবাবুর আত্মহত্যা, তা-ও আগুনে পুড়ে— বড্ড নাটুকে। মনে হয়, পার্থ দে-র এখনও অনেক কিছু কবুল করার আছে।