Vidyasagar College Vandalization

ভাঙচুরের স্মৃতি এখনও টাটকা বেকার ল্যাবে

একতলার সেই বিশাল ঘরের সামনে দাঁড়ালে এখনও বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। কয়েক প্রজন্মের কিংবদন্তীপ্রতিম বাঙালি বিজ্ঞানসাধকের সলতে পাকানোর স্মৃতি মিশে আছে সেখানে।

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০১৯ ০০:৫৮
Share:

প্রেসিডেন্সির সেই ল্যাবরেটরি। বুধবার। নিজস্ব চিত্র

ঐতিহাসিক পোর্টিকো পেরিয়ে বাঁয়ে হেঁটে আসতে হবে খানিকটা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মাঠের ধার দিয়ে এগিয়ে বেকার ল্যাবরেটরি ভবন।

Advertisement

একতলার সেই বিশাল ঘরের সামনে দাঁড়ালে এখনও বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। কয়েক প্রজন্মের কিংবদন্তীপ্রতিম বাঙালি বিজ্ঞানসাধকের সলতে পাকানোর স্মৃতি মিশে আছে সেখানে। প্রেসিডেন্সির পদার্থবিদ্যার সেই গবেষণাগারে ঠিক ছ’বছর আগে কার্যত তাণ্ডব চালিয়েছিল রাজনৈতিক পেশিশক্তি। বিদ্যাসাগরের মূর্তি ধ্বংসের সূত্র ধরে সেই ঘটনাটিও অনেকের মনে সজীব।

‘‘পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে মানবাধিকার কমিশনের কাছে রিপোর্ট পাঠিয়েছিলাম আমি। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের ছেলেরা দলের এক কাউন্সিলরকে সঙ্গে নিয়ে বিনা প্ররোচনায় হামলা চালায়। ল্যাবরেটরি তছনছ করে। কমিশন সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে শাস্তির সুপারিশ করলেও মানেনি রাজ্য সরকার।’’— বুধবার বিকেলে কথাগুলো বলছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ তথা বেকার ল্যাবরেটরি ভাঙচুর-কাণ্ডে তদন্তের ভারপ্রাপ্ত অমল মুখোপাধ্যায়। বাংলার ঐতিহ্যের অবমাননা নিয়ে ফের রাজনীতির সুর চড়লেও কিছু ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের সেই নীরবতায় ক্ষুব্ধ অমলবাবু।

Advertisement

পদার্থবিদ্যার গবেষণাগারে ভাঙচুরের তদন্তের কী হল? জবাবে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘তখন আমি শিক্ষামন্ত্রী ছিলাম না! কী হয়েছিল, এখন ঠিক মনে নেই।’’ এ দিন সেই গবেষণাগারে ঢুকে চোখে পড়ল ছ’বছর আগের তাণ্ডবভূমির টেবিল। মাটিতে আছড়ে ভাঙা শব্দের গতিবেগ (অ্যাকাউস্টিক ভেলোসিটি) জরিপ করার যন্ত্রটি এখনও অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। বাঁ দিক থেকে ডান দিকের টেবিলে তার শুধু ঠাঁই বদলেছে। গবেষণাগারের বাইরের ফলকে লেখা প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের কথা। পদার্থবিদ্যা বিভাগের এই অংশটিতেই প্রশান্তবাবু প্রেসিডেন্সির স্ট্যাটিস্টিক্স-চর্চা তথা ‘ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট’-এর সূচনা করেন। ১৯১৫-১৯৫৩ এই ল্যাবরেটরিতেই সারস্বত-সাধনায় মগ্ন ছিলেন তিনি।

ওই গবেষণাগারে এখনও রয়েছে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর ব্যবহৃত মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গ আবিষ্কার এবং শনাক্তকরণের যন্ত্রের প্রতিকৃতি। প্রেসিডেন্সির পদার্থবিদ্যার শিক্ষকদের মতে, জগদীশ বসুর সময়ে হয়তো এই গবেষণাগার গড়ে ওঠেনি। মূল ভবনের একতলার কোনও ঘরে তিনি কাজ করতেন। ১৯১৩ নাগাদ চালু হয় বেকার ল্যাবরেটরি ভবন। প্রবীণ পদার্থবিদ বিকাশ সিংহের কথায়, ‘‘ওই ল্যাবে ঢুকলেই তখন উৎকর্ষের পরম্পরা টের পেতাম। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত বেকার ল্যাবরেটরিতে যে কাজ করেছি, পরে কেমব্রিজে গিয়ে সেই কাজই আমাদের করতে হয়!’’ কিন্তু ইদানীং এখানে ঢুকতেও কষ্ট হয় বিকাশবাবুর। ‘‘এই গবেষণাগারটি পরে আর যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি। আমাদের সময়ে যা ছিল, তা-ই পড়ে আছে। এবং সব কিছুর রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাজনীতি ঢুকে পড়েছে।’’ ছ’বছর আগের সেই হামলায় কাচ ভেঙেছিল ল্যাবের। বেশ কিছু ছাত্র ও এক জন শিক্ষক আহত হয়েছিলেন। সেটুকুর মেরামতিটাই যা হয়েছে, এই ক’বছরে!

‘‘তখন বেকার ল্যাবরেটরির দিকটায় ওয়াইফাই মিলত বলেও অনেক ছাত্রছাত্রীর ভিড় লেগে থাকত। ল্যাবরেটরির সামনে দাঁড়িয়ে টিএমসিপি-র মার আমিও খেয়েছিলাম।’’— বললেন তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এমএ-র ছাত্র দেবর্ষি সরকার। এখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন। দেবর্ষিও বলছেন, ‘‘পুলিশে অভিযোগ সত্ত্বেও কেউ কিছু করেনি।’’ সে বার দিল্লিতে এসএফআই-এর বিক্ষোভে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের হেনস্থার প্রতিবাদে রাজ্যে প্রতিবাদ-দিবস চলছিল টিএমসিপি-র। ‘‘আমি তদন্তে নিশ্চিত জানতে পারি, কোনও প্ররোচনা ছাড়াই ওদের একটি মিছিল প্রেসিডেন্সিতে ঢুকে পড়ে। মারধর, অশালীনতম গালিগালাজ করে।’’— বলছেন তদন্ত কমিটির ভারপ্রাপ্ত অমলবাবু। ভাঙচুরের পরে গবেষণাগারে একটি জ্যাভলিনও মিলেছিল বলে তদন্তে প্রকাশ। সেই ‘তাণ্ডব’-এর নেতা, তৃণমূলের ছাত্রনেতা শঙ্কুদেব পণ্ডা এখন বিজেপি-তে। তিনি বলেন, ‘‘আগে আমার নতুন দলের অনুমতি নিই, তার পরে এ বিষয়ে বলব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন