পাড়া বলতেই ডুব দিই নস্ট্যালজিয়ায়! তাতে মিশে আছে অজস্র সুখস্মৃতি, উষ্ণ-আন্তরিক মুহূর্ত আর ভালবাসা। এখানেই তো জন্ম, বেড়ে ওঠা— কৈশোর, যৌবন অতিক্রম করে এখন চলছে বার্ধক্যের দিনযাপন। কখনও এক মুহূর্তের জন্যও একঘেয়ে লাগে না। আসলে এ পাড়ার অলিতে-গলিতে, দেওয়ালের ইট-সুড়কির ধূলিকণায় কিংবা আবহাওয়ায় মিশে আছে এক অদৃশ্য আকর্ষণী শক্তি। সেটাই এতগুলো বছর দুঃখে সুখে সকলকে পাশাপাশি ধরে রেখেছে এক আজানা বন্ধনে।
এক কথায় এ পাড়ার বিস্তৃতি গ্যালিফ স্ট্রিটের মোড় থেকে টালা পার্ক পর্যন্ত। বাড়ির ঠিকানা মধুসূদন চ্যাটার্জি লেন হলেও, কাছেই কালীকুমার ব্যানার্জি লেন কিংবা বনমালি চ্যাটার্জি স্ট্রিটও পাড়ার চৌহদ্দির মধ্যেই অবস্থিত।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য অনেক বদলে গিয়েছে আমাদের পাড়া। পাড়ায় পুরনো বাসিন্দা আজ হাতে গোনা। অনেকেই চলে গিয়েছেন অন্যত্র। আর নতুন যাঁরা এসেছেন তাঁদের কারও সঙ্গে সম্পর্কটা উপর উপর, অনেকের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগই মেলেনি। বরং যোগাযোগ কমলেও পুরনো পড়শিদের সঙ্গে আগের মতোই আন্তরিক সম্পর্ক আছে। তবে মেলামেশার পরিধিটা যেন সীমিত হয়ে এসেছে। আগের মতো প্রাণ খুলে কথা বলার মানুষও কমে আসছে ক্রমেই।
এখানেও একে একে পুরনো বাড়ি ভেঙে তৈরি হচ্ছে বহুতল। বাঙালিদের পাশাপাশি আসছেন অবাঙালিরা। পাড়ার মিশ্র সংস্কৃতি প্রভাব ফেলছে জীবনযাত্রায়। তবু আমাদের পাড়াটা এখনও শান্তিপূর্ণ, নির্ঝঞ্ঝাট। বাসিন্দাদের মধ্যে ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকলেও তা নিয়ে কোনও বিভাজন কখনও তৈরি হয়নি। দেখে ভাল লাগে যে বিপদে-আপদে এখনও সকলে প্রতিবেশীদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন।
আমাদের ছেলেবেলার পাড়া মানে ছিল সীমাহীন আনন্দ। পুজোর আগে আমাদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল মজুমদার বাড়ির প্রতিমা নির্মাণের বিভিন্ন পর্ব। সেই পুজোটা আজও হয়। তাতে সময়ের সঙ্গে জৌলুস কিংবা থিমের প্রাধান্য বাড়লেও হারিয়েছে পাড়ার পুজোর সেই গন্ধটা। হারিয়েছে পাড়ার আড্ডার জমজমাট পরিবেশও। এখন বিক্ষিপ্ত ভাবে কিছু রকে প্রবীণেরা বসলেও সেই মাদকতাটা আর নেই।
নাগরিক পরিষেবা ঠিকমতো মিললেও কিছু মানুষের সচেতনতার অভাবে রাস্তাঘাট অপরিষ্কার হয়ে যায়। সাফাইয়ের পরেই জানলা দিয়ে রাস্তায় আছড়ে পড়ে প্লাস্টিকবন্দি আবর্জনা। এখন আর আগের মতো রাস্তায় বৃষ্টির জল জমে না। মশার উপদ্রব কমেছে। কাউন্সিলর ভালই কাজ করছেন। মানুষের সুবিধা-অসুবিধার খবর রাখেন তিনি।
এ পাড়ায় আজও বজায় আছে খেলাধুলোর অভ্যেসটা। পাড়ার কিছু ক্লাবের উদ্যোগে হয় ক্রিকেট-ফুটবল টুর্নামেন্ট। ক্লাব সংলগ্ন মাঠে আজও বিকেলে ছোটরা খেলাধুলো করে। স্থানীয় ক্লাবগুলির উদ্যোগে হয় রক্তদান শিবির, বসে আঁকো প্রতিযোগিতা। তাদের উদ্যোগেই তৈরি হয়েছে একটি ‘জিম’ও।
এক কালে কাছাকাছির মধ্যে থাকতেন বহু স্বনামধন্য মানুষ। যেমন প্রখ্যাত তবলিয়া হীরেন্দ্রকুমার গঙ্গোপাধ্যায় (হীরুবাবু) ও কৃষ্ণকুমার গঙ্গোপাধ্যায় (নাটুবাবু)। সেতারি মুস্তাক হুসেন খান, অভিনেতা কানু বন্দ্যোপাধ্যায়, গঙ্গাপদ বসু, সজনীকান্ত দাস, শৈলেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, অপর্ণা দেবী, নবেন্দু চট্টোপাধ্যায়, প্রবীর মুখোপাধ্যায়, পীযূষকান্তি সরকার প্রমুখ।
এ অঞ্চলে ছিল সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক পরিবেশ। কাছেই ব্যবসায়ী তপন মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে বসত ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসর। কে না এসেছেন সেখানে— আলাউদ্দিন খান, আলি আকবর খান, রবিশঙ্কর। এক বার পাড়ারই এক অনুষ্ঠানে এসেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে। তাঁর দু’পাশে তানপুরায় ছিলেন মান্না দে ও প্রভাস দে। এই সব আসরের স্মৃতি জড়িয়ে আছে পাড়ার আনাচে-কানাচে। এখনও পাড়ায় বিজয়া সম্মিলনী ও গানের জলসা হলেও অতীতের সেই কৌলিন্য আর নেই। তেমনই গান শুনতে আর উপচে পড়ে না শ্রোতাদের ভিড়। একটু একটু করে সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ফলে পাড়ায় বাঙালিয়ানা যেন ক্ষীণ হয়ে আসছে।
লেখক সঙ্গীতশিল্পী ও চিকিৎসক
ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য