Lionel Messi in Kolkata: Salt Lake Stadium vandalised

মেসির প্রবেশ ও অকালপ্রস্থানের সেই ‘শনিপথ’ এখন কী অবস্থায়? রবিবার সরেজমিনে যুবভারতী সফর করল আনন্দবাজার ডট কম

মেসিকে ঘিরে থাকা অবাঞ্ছিত ভিড়, সেই ভিড়ে ছবি তোলার হিড়িক এবং তজ্জনিত কারণে বিরক্ত লিয়োর অকালপ্রস্থানের প্রতিক্রিয়ায় যে তাণ্ডব চলেছিল শনিবার, রবিবারের যুবভারতী দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই কলঙ্কের সংগ্রহশালা হিসাবে।

Advertisement

শোভন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৯:২৮
Share:

যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন। শনিবার লিয়োনেল মেসি স্টেডিয়াম থেকে চলে যাওয়ার পরে তাণ্ডব চলে এখানে। — নিজস্ব চিত্র।

নীল রঙের কার্পেটটি এখনও টানটান। অমলিন। কিন্তু তার উপরে লাগানো জালে কলঙ্কিত ১৩ ডিসেম্বরের অভিজ্ঞান হয়ে ঝুলে রয়েছে ডজনখানেক ভাঙা চেয়ার। আর কার্পেট শেষ হওয়ার পরে লালরঙের অ্যাথলেটিক ট্র্যাক এবং সেই ট্র্যাকের পরে সবুজ ঘাসের উপর চেয়ার, বোতল, সাউন্ড সিস্টেমের নানাবিধ জিনিস এবং হোর্ডিংয়ের স্তূপ। শনিবার যে পথ দিয়ে যুবভারতীতে প্রবেশ এবং অকালপ্রস্থান করেছিলেন লিয়োনেল মেসি, ২৪ ঘণ্টা পরে সেই ‘অগ্নিপথের’ আশপাশ জুড়ে শুধুই গণক্রোধের আগুনে পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া ছবির কোলাজ। ২৪ ঘণ্টা পরেও।

Advertisement

রবিবার দুপুর সওয়া ১টা নাগাদ সল্টলেক স্টেডিয়ামের পাঁচ নম্বর গেটের (ইএম বাইপাসের উপর) সামনে পৌঁছে দেখা গেল, মূল ফটক বন্ধ। গেটের পাশে নিরাপত্তারক্ষীদের খুপরিতে দু’এক জনের মাথা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেই পর্যন্ত পৌঁছোতে কসরত করতে হল। কারণ উল্টো হয়ে পড়ে রয়েছে শনিবার মেসিকে স্বাগত জানানোর তোরণ। ‘গোট গেট’। সেটি টপকে নিরাপত্তাকর্মীদের কাছাকাছি পৌঁছোতেই এক জন জানিয়ে দিলেন, ‘‘মিডিয়া আজকে এই গেট দিয়ে ঢুকতে পারবে না।’’ তা হলে কোন গেট দিয়ে? ‘‘তিন নম্বরে চলে যান।’’ যুবভারতীর অবস্থান সম্পর্কে যাঁরা জানেন, পাঁচ নম্বর থেকে তিন নম্বর গেটে যাওয়া মানে স্টেডিয়ামের এক গোলার্ধ থেকে অন্য গোলার্ধে যাওয়া।

মাঠে প্রবেশ করতেই হবে। অ্যাসাইনমেন্টের মূল কথা ‘আঁখো দেখা’ বিবরণ চাই। অগত্যা শুরু হন্টন। মিনিট ২০ হেঁটে একটি ই-রিক্সা ধরে ৩ নম্বর গেট। সেই ফটক খোলা। প্রবেশ করার পর কিছুটা এগোতেই গ্যালারির নীচের হোটেলের নিরাপত্তাকর্মীরা জানিয়ে দিলেন, যেতে হবে ভিআইপি গেটের কাছে। যেখানে স্বামী বিবেকানন্দের পূর্ণাবয়ব মূর্তি রয়েছে। স্টেডিয়ামের ভিতরের পিচ রাস্তা ধরে ফের চক্কর। ফাঁকফোকর দিয়ে উঁকিঝুকি মারার চেষ্টা। প্রথম তিনটি র‌্যাম্পে ঠোক্কর খেয়ে এক এবং দুই নম্বর গ্যালারির মাঝের একটি র‌্যাম্পের একটি ফাঁক চোখে পড়ল। একটি পর্বতারোহণ সংগঠনের অফিসের এক কর্তার মোটরসাইকেল রাখা। মরিয়া হয়ে তাঁকেই অনুরোধ মোটরসাইকেলটি ডবল স্ট্যান্ড করার জন্য। পর্বতারোহণ সংগঠনের কর্তা হলেও তাঁর মন পাথরের মতো নয়। নরম। বাইকে ডবল স্ট্যান্ড করতেই তার উপর দাঁড়িয়ে দেখা গেল, শনিবারের যে ছবি নিয়ে সন্ধে নেমেছিল যুবভারতীতে, রবিবার সকালে তার কোনও পরিবর্তন হয়নি।

Advertisement

যুবভারতী স্টেডিয়ামে রবিবারেও পড়ে রয়েছে ভাঙা চেয়ার। ছবি: পিটিআই।

তার পর আরও কয়েকটি র‌্যাম্পে উঁকিঝুকি দিয়ে, সোজা চার এবং পাঁচ নম্বর গ্যালারির মাঝের র‌্যাম্প। মেসির প্রবেশ এবং অকালপ্রস্থানের অগ্নিপথ। সেখানে ঢুকতেই পিছন থেকে আওয়াজ এল, ‘‘কোথায় যাচ্ছেন? আরে কোথায় যাচ্ছেন?’’ প্রশ্ন করছেন এক পুলিশকর্মী। বলতে বলতেই এগিয়ে এসে জানিয়ে দিলেন, ‘‘ভিতর পর্যন্ত যাওয়া যাবে না।’’ কিন্তু ‘আঁখো দেখা’ দেখতেই হবে। তিনি যেতে দেবেন না। কিন্তু যেতে তো হবেই। মিনিট পাঁচেকের বেশি বিনিয়োগ করে ফের এগোনো। কিন্তু তার মধ্যেই ফের বলে দিলেন, ‘‘দু’মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে আসবেন।’’ তা-ই সই। আরও কয়েক পা এগিয়ে দেখা গেল রাজ্য সরকারের যুব আবাসের কোলাপসিবল গেট বন্ধ। সামনে পড়ে রয়েছে ভাঙা চেয়ারের স্তূপ।

সেখানে কোনও মোটরসাইকেল নেই। কী হবে? গেটের নীচের অংশে পা দিয়ে সামান্য বেয়ে উঠে মোবাইল উঁচু করে ছবি তোলার চেষ্টা। কিন্তু সে তো ছবি দেখা। ‘আঁখো দেখা’ নয়। ঘাড় ঘোরাতেই দেখা গেল এক নিরাপত্তারক্ষী একটি চেয়ারে বসে ছিলেন, তিনি তখন সেটা থেকে উঠে মোবাইলে কারও সঙ্গে কথা বলছেন। ছোঁ মেরে সে চেয়ার টেনে গেটের উপর উঠে মাঠ দেখার চেষ্টা। এক এবং দুই নম্বর গ্যালারির মাঝের একটি র‌্যাম্প থেকে যে ছবি দেখা গিয়েছিল, তেমনই ছবি এখানেও। কিন্তু এ পথের মাহাত্ম্য ভিন্ন। মেসির প্রবেশ এবং অকালপ্রস্থানের পথ। শুধু মেসি? ২২ মিনিটের মাথায় লিয়োর প্রস্থানের পরে যখন বোতল পড়া শুরু হয়েছিল শনিবার, এই পথ দিয়ে পারিষদবর্গকে নিয়ে প্রস্থান করেছিলেন রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসও। যে অরূপ যুবভারতী কেলেঙ্কারির পরে ফুটবল জনতার কাঠগড়ায়। যে অরূপকে অতীতে এমন কোনও প্যাঁচে পড়তে হয়নি।

মেসিকে ঘিরে থাকা অবাঞ্ছিত ভিড়, সেই ভিড়ে ছবি তোলার হিড়িক এবং তজ্জনিত কারণে বিরক্ত লিয়োর অকালপ্রস্থানের প্রতিক্রিয়ায় যে তাণ্ডব চলেছিল শনিবার, রবিবারের যুবভারতী দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই কলঙ্কের সংগ্রহশালা হিসাবে। যেখানে প্রবেশ করতে শনিবার সন্ধ্যায় ব্যর্থ হওয়ার পরে রবিবার সফল হয়েছেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। রবিবার যুবভারতী ঘুরে দেখল প্রাক্তন বিচারপতি অসীম কুমার রায়ের নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটি। যাতে ছিলেন রাজ্যের মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ, স্বরাষ্ট্রসচিব নন্দিনী চক্রবর্তী এবং বিধাননগর পুলিশের বড় কর্তারা। এই কমিটি স্টেডিয়াম পরিদর্শনের পরে দীর্ঘ বৈঠকও করেছে। যদিও বেরিয়ে বিশেষ কোনও মন্তব্য করেননি কেউ। প্রাক্তন বিচারপতি রায় শুধু বলেছেন, ‘‘এখনই কাটাছেঁড়া করবেন না। আমরা সক্রিয় ভাবে সব দিক তদন্ত করে দেখছি। আমরা যা যা দেখেছি, তার নোট নিয়েছি। আমাদের রিপোর্টে সব কিছুর উল্লেখ থাকবে।’’

কত টাকার ক্ষতি হয়েছে? পূর্ত দফতরের কর্তারা এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনও মন্তব্য করতে চাননি। মন্তব্য করতে চাননি মন্ত্রী পুলক রায়ও। তবে একান্ত আলোচনায় সরকারি আধিকারিকেরা কেউ কেউ বলছেন, ১০ কোটির উপর চলে যেতে পারে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ। কেউ কেউ মনে করছেন, আরও অনেক বেশি। শুধুমাত্র চেয়ার ভাঙা হয়েছে বা স্টেডিয়ামের বিভিন্ন কাঠামোয় গণক্রোধ আছড়ে পড়েছে তা-ই নয়, সার্বিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে খেলার মাঠ। অ্যাথলেটিক ট্র্যাকও। একটি মাঠে যদি এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে হাজার হাজার লোক চষে বেড়ায়, সেটা যে আর খেলার উপযুক্ত মাঠ থাকে না, তা বলাই বাহুল্য। তবে শাসকদলের নেতাদের অনেকেরই বক্তব্য, আর্থিক খরচ তেমন বিরাট অঙ্কে হয়তো যাবে না, কিন্তু ভাবমূর্তির যে ক্ষতি হয়েছে, তা ইতিহাস হয়ে থাকবে। সেই ইতিহাস কলঙ্কের। যত বার ফুটবল নামক শব্দটি উচ্চারিত হবে কলকাতায়, তত বার ফিরে ফিরে আসবে ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫।

কবে ছন্দে ফিরবে যুবভারতী? সে উত্তরও স্পষ্ট করে নেই প্রশাসনের কাছে। কলঙ্কজনক ইতিহাস তৈরির ২৪ ঘণ্টা পরেও যে যুবভারতী আসলে কলঙ্কের সংগ্রহশালা হিসাবেই আপাতত উদ্ভাসিত হচ্ছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement