শহরে বিপজ্জনক বাড়ি

ঠাণে পারলেও কলকাতা পারবে কবে, প্রশ্ন সেখানেই

এই শহরে পুরসভা ‘বিপজ্জনক বাড়ি’ ভাঙতে চায় না। আর্থ-সামাজিক প্রশ্ন তোলেন পুর-কর্তারা। অথচ একই কাজ করে দেখাচ্ছে মহারাষ্ট্রের ঠাণে।

Advertisement

অনুপ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০১৬ ০১:১৩
Share:

মধ্য কলকাতার একটি বিপজ্জনক বাড়ি। — নিজস্ব চিত্র।

এই শহরে পুরসভা ‘বিপজ্জনক বাড়ি’ ভাঙতে চায় না। আর্থ-সামাজিক প্রশ্ন তোলেন পুর-কর্তারা। অথচ একই কাজ করে দেখাচ্ছে মহারাষ্ট্রের ঠাণে।

Advertisement

চোখ মেললেই ‘বিপজ্জনক বাড়ি’ লেখা নোটিস নজরে পড়ে কলকাতায়। বছরের পর বছর লটকে থাকা সেই নোটিস ফিকে হয়ে গিয়েছে, তবু সমাধান হয়নি। পথচলতি মানুষকেও বিপদের ঝুঁকি নিয়ে চলতে হয় ওই সব বাড়ির পাশ দিয়ে। আর সেই দশা ঘোচানোর দায়িত্ব যাদের উপর, সেই কলকাতা পুর-প্রশাসনও চোখে ঠুলি দিয়ে রয়েছেন বলে অভিযোগ। অভিজ্ঞতা বলে, ওই বাড়ি খালি করা বা ভেঙে ফেলার ব্যবস্থা করতে কোনও উদ্যোগই নেই পুরকর্তাদের। প্রশ্ন উঠলেই তাঁদের যুক্তি, যাঁরা বাস করেন তাঁদের তো আর সরিয়ে দেওয়া যায় না। তাই কিছু করার নেই।

অথচ একই সমস্যার সমাধানে অনেকটাই তৎপর মহারাষ্টের ঠাণে পুর নিগম। শহরের বিপজ্জনক বাড়ি খালি করে তা ভেঙে ফেলতে চায় তারা। এ মর্মে ঠাণে পুর-প্রশাসন নির্দেশ দিয়েছে, বিপজ্জনক বাড়িতে যাঁরা থাকেন প্রথমে তাঁদের সরাতে হবে। পরে তা সংস্কার করতে বাধ্য করানো হবে।

Advertisement

এখন প্রশ্ন, ঠাণে পুর নিগম পারলে কলকাতা নয় কেন? ঠাণের পুরকর্তাদের যুক্তি, জীবনহানির সম্ভাবনা থাকলে তা আগে দেখা উচিত। বিপজ্জনক বাড়ি বছরের পর বছর থাকতে পারে না। কলকাতা পুরসভা অবশ্য জানিয়েছে, লোক সরিয়ে বাড়ি ভাঙার সিদ্ধান্ত তাঁরা নিতে চান না। আর তাতে বিপজ্জনক বাড়ি ভেঙে পড়লেও তাঁদের যে কিছু করার নেই, ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছেন পুর-কর্তারা। ছড়িয়ে থাকা বিপজ্জনক বাড়ির সংখ্যাও তাই ক্রমে বেড়ে যায়।

মানিকতলা মোড়ের কাছে রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটের মুখে রাস্তার উপরেই কিছু বছর ধরে বিপজ্জনক ভাবে রয়েছে একটি বাড়ি। নীচে দু’তিনটি দোকান। গাড়ি বারান্দার স্তম্ভগুলির ভগ্নদশা। দেখলেই মনে হবে যে কোনও সময়ে ভেঙে পড়বে। আতঙ্কে স্থানীয়েরাও।

বড়বাজার সংলগ্ন পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিট, বা মধ্য কলকাতায় এস এন ব্যানার্জি রোডেও গোটা কয়েক বাড়ি রয়েছে বিপজ্জনক অবস্থায়। পুরসভা কেবল ‘বিপজ্জনক বাড়ি’র নোটিস লিখে দিয়েছে। ক্রিক রো-এ সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে ঢোকার মুখে দু’পাশের ভগ্ন বাড়ির মাঝখান দিয়ে যেতে গিয়ে মনে হয় এই বুঝি ভেঙে পড়বে! সব জেনেও নিরুত্তাপ পুর-প্রশাসন। পুরসভার বিল্ডিং দফতরের দেওয়া হিসেবেই শহরে বিপজ্জনক বাড়ি তিন হাজারেরও বেশি। এর মধ্যে খুবই বিপজ্জনক শ’পাঁচেক, যার বেশিরভাগই উত্তর ও মধ্য কলকাতায়।

ঠাণের পুর-কমিশনারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ওই শহরে বিপজ্জনক বাড়ি ২৭৩২টি। ৯০টির হাল অত্যন্ত খারাপ। ওই পুরসভার এক আধিকারিক জানান, ঝড়-বৃষ্টির কারণে ঠাণে পুর-এলাকার কিছু জায়গা সম্প্রতি জলমগ্ন হয়। তার মোকাবিলা করতে গিয়েই পুর-প্রশাসনের নজরে আসে বিপজ্জনক বাড়ির অবস্থা। তা ভেঙে পড়লে প্রাণহানি হতে পারে। স্থানীয়দের সুরক্ষার কথা ভেবেই বিপজ্জনক বাড়িগুলি ভাঙার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানান ওই আধিকারিক। ঠাণে পুরসভা সূত্রে খবর, পুর-কমিশনার সঞ্জীব জায়সবাল সম্প্রতি এক নির্দেশ দিয়ে জানিয়েছেন, যত শীঘ্র সম্ভব বিপজ্জনক বাড়ি থেকে লোক সরানো হোক। তা কার্যকর করার দায়িত্ব তিনি দিয়েছেন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারকে। ওই নির্দেশে বলা হয়েছে, কেউ কাজে বাধা দিলে পুলিশের কাছে এফআইআর করতে হবে। ঠাণে পুরসভা সূত্রে খবর, ইতিমধ্যেই ২২টি বিপজ্জনক বাড়ি খালি করা হয়েছে। কাজ চলছে বাকিগুলির। বাড়ি খালি হলেই পরবর্তী পদক্ষেপ করা হবে বলে জানিয়েছে পুরসভা।

কলকাতা পুরসভার বিল্ডিং দফতরের ডিজি (২) দেবাশিস চক্রবর্তী বলেন, ‘‘মানুষের আর্থ-সামাজিক দিকটিও দেখতে হয়। বাড়িতে কেউ থাকলে তাঁকে সরানোর পক্ষপাতী নয় কলকাতা পুরসভা।’’ কিন্তু বিপজ্জনক বাড়িটি ভেঙে পড়লে তো প্রাণহানি হতে পারে। সেটা কি ভেবে দেখেছে পুর-প্রশাসন? এর সদুত্তর দেননি ডিজি। শুধু বলেছেন, ‘‘বাড়ি বিপজ্জনক হলে পুর ইঞ্জিনিয়ারেরা পরীক্ষা করে দেখেন। তার পরে সেখানে ‘বিপজ্জনক’ লেখা বোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হয়। যাতে স্থানীয়েরা সে সম্পর্কে সতর্ক থাকতে পারেন।’’

কিন্তু তাতে কী দুর্ঘটনা ঠেকানো সম্ভব? এক পুর আমলার কথায়, ‘‘কী আর করা যাবে! জোর করে কিছু করতে চায় না পুর-প্রশাসন। অনেক ক্ষেত্রে মামলাও হয়। সমস্যা আরও বাড়ে।’’ তিনি আরও জানান, অনেক সময়ে দেখা গিয়েছে বহু বছর ধরে থাকা বাসিন্দাকে তুলতে মালিক বাড়ি সারান না। তাঁদের উদ্দেশ্য, বাড়িটি ভেঙে পড়লে ভাড়াটে সরে (উচ্ছেদ) যাবে। সেই ফাঁকে ওখানে নতুন বাড়ি তৈরি করা যাবে। সে সব মতলব রুখতেই অনেক সময়ে বিপজ্জনক বাড়ি জেনেও চুপ করে থাকে প্রশাসন।

তবে কলকাতার যুক্তির সঙ্গে সহমত নন ঠাণের পুর-প্রশাসন। ঠাণে পুরসভার এক আমলা জানান, বিপজ্জনক বাড়ি ভেঙে পড়ে কারও প্রাণহানি হলে দায়বদ্ধতা পুরসভার ঘাড়েই পড়বে। আর বিপজ্জনক বাড়ি ভেঙে নতুন করে গড়া বাড়িতে ভাড়াটেদের ঠাঁই দেওয়ার আইন তো কলকাতাও করেছে। তা হলে উচ্ছেদের প্রশ্ন আসে কী করে?

বিপজ্জনক বাড়ি ভাঙার সিদ্ধান্তটা কঠিন। তা গ্রহণ করতে একটু কঠোর হতে হবে পুর-প্রশাসনকে। ঠাণের পুর কমিশনার সঞ্জীব জায়সবাল পারলেও সেই সাহস দেখাতে অপারগ কলকাতার পুর-কমিশনার খলিল আহমেদ। ওই পথে হাঁটতে নারাজ কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন