রক্ত চেয়ে ফোন এলেই ব্যস্ততা বাড়ে দৃষ্টিহীন লজেন্স বিক্রেতার

আপাত এই রংহীন জীবনে হঠাৎ ব্যস্ততা বেড়ে যায় রক্ত চেয়ে ফোন এলে। সম্প্রতি এক দুপুরে সে রকমই ফোন এসেছিল। খাওয়া শেষে, পা গুনে গুনে থালা বারান্দায় নামিয়ে রেখে ব্যস্ত ভাবে তপনবাবু জানালেন, ফোন এসেছিল। রক্ত দরকার। যেতেই হবে। স্ত্রীকে বললেন, ‘‘তুমি দরজা দিয়ে শুয়ে থেকো। আমি স্টেশন হয়ে রাতে ফিরব।’’

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৪:২৭
Share:

বাড়ি থেকে বেরিয়ে লজেন্স বিক্রির পথে তপন দে। সঙ্গে স্ত্রী ইতি দে হালদার। —নিজস্ব চিত্র।

ঘরের বাসিন্দা বলতে স্বামী-স্ত্রী আর দু’টো ধেড়ে ইঁদুর! শোভাবাজারের শশী শূর লেনে এ ভাবেই থাকেন তপন দে এবং তাঁর স্ত্রী ইতি দে হালদার। দশ ফুট বাই বারো ফুটের ঘরে আসবাব কিছুই নেই। একটা ছোট চৌকি আর দু’বেলা রান্না করে খাওয়ার বাসনপত্র। পুরনো একটা ছোট টিভি পড়ে আছে ঘরের এক কোণে। তবে তা চলে না দীর্ঘদিন। তা ছাড়া, টিভি থেকেই বা লাভ কী? স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই যে দৃষ্টিহীন!

Advertisement

আপাত এই রংহীন জীবনে হঠাৎ ব্যস্ততা বেড়ে যায় রক্ত চেয়ে ফোন এলে। সম্প্রতি এক দুপুরে সে রকমই ফোন এসেছিল। খাওয়া শেষে, পা গুনে গুনে থালা বারান্দায় নামিয়ে রেখে ব্যস্ত ভাবে তপনবাবু জানালেন, ফোন এসেছিল। রক্ত দরকার। যেতেই হবে। স্ত্রীকে বললেন, ‘‘তুমি দরজা দিয়ে শুয়ে থেকো। আমি স্টেশন হয়ে রাতে ফিরব।’’

শিয়ালদহ স্টেশনে উত্তরবঙ্গের ট্রেনে লজেন্স ফেরি করেন তপনবাবু। তবে তাঁর পরিচিতি রক্তদাতা হিসেবে। এলাকার লোকের তো বটেই, রক্তের প্রয়োজন পড়লে শহরের নানা প্রান্ত থেকে ফোন আসে তাঁর কাছে। লাঠি হাতে লজেন্সের ব্যাগ নিয়েই পৌঁছে যান রক্ত দিতে। তাঁর কথায়, ‘‘চোখে দেখতে পাই না। বুঝি, জীবনটা কতটা অন্ধকার। আমার রক্তে যদি কারও জীবনে আলো ফেরে, ক্ষতি কী? তাই কেউ ডাকলেই চলে যাই।’’ তবে এক বার রক্ত দেওয়ার দু’-তিন মাসের মধ্যেই ফোন এলে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, দিন কয়েক আগেই রক্ত দিয়েছেন। এখনই আবার দেওয়া যাবে না। তপনবাবুর দাবি, ‘‘রক্ত নিয়ে এখন ব্যবসা চলছে। লোকে ঘন ঘন রক্ত দিচ্ছে। উপহার, টাকা কত কী! আমি গরিব হতে পারি, কিন্তু অর্থের জন্য কখনও রক্ত দিইনি।’’

Advertisement

অথচ তপন-ইতির দৃষ্টিহীন দাম্পত্যে এই অর্থেরই অভাব সবচেয়ে বেশি। ছোটবেলায় ক্রিকেট-বল লেগে একটি চোখে দৃষ্টি হারান তপনবাবু। পরে অন্য চোখেরও দৃষ্টি চলে যায়। ২০০৭ সালে হৃদ্‌রোগে মৃত্যু হয় প্রথম পক্ষের স্ত্রীর। তখন তাঁর দুই মেয়ে। পরে ইতিদেবীকে বিয়ে করেন তপনবাবু। ছোটবেলায় ইতিদেবীও দৃষ্টি হারিয়েছেন। তিনি সল্টলেকের এক বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করতেন। এখন ছেড়ে দিতে হয়েছে। কারণ? ইতিদেবী বললেন, ‘‘বাসে করে প্রথমে কাজে যেতাম। তবে অন্ধ বলে অনেক কন্ডাক্টর আমাদের বাসে তুলতে চান না। জোরে বাস চালিয়ে দেন। কয়েক দিন অটো করে গিয়েছি। কিন্তু রোজ অটো করে যাওয়ার টাকা কোথায়?’’

টাকার অভাবে সন্তানদেরও সঙ্গে রাখতে পারেননি ইতিদেবীরা। প্রথম পক্ষের দু’জন এবং তাঁর নিজের দুই সন্তান মিলে ইতিদেবীর এখন চার কন্যা। সকলেই হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে। তপনবাবু বলেন, ‘‘কিছু মানুষের সাহায্যে হস্টেলে রেখে ওদের পড়াতে পারছি। একে তো টাকা নেই, তার উপরে ওদের বাবা-মা অন্ধ। ডান দিকে যেতে বলব, বাঁ দিকে গিয়ে বলবে যে ডান দিকেই গিয়েছে। আমরা ধরতেও পারব না। তার থেকে হস্টেলে থেকে মানুষ হোক।’’ জানালেন, গরমের ছুটিতে বাড়ি এসেছিল মেয়েরা। ছোট্ট ঘরে তাঁদের নিয়েই দারুণ সময় কেটেছে বাবা-মায়ের।

তপনবাবুর কথা শুনে ওয়েস্ট বেঙ্গল ভলান্টারি ব্লাড ডোনার্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক অপূর্ব ঘোষ বলছেন, ‘‘আমরা যাঁরা চোখ থাকা সত্ত্বেও রক্তদানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অন্ধ হয়ে রয়েছি, তাঁদের তপনবাবুর কাছ থেকে শেখা উচিত। ভদ্রলোক এই কাজ চালিয়ে যান।’’

গল্প বলতে বলতে তপনবাবুর হঠাৎ খেয়াল হল, রক্ত দিতে যেতে হবে। জানতে চাইলেন, ক’টা বাজে? হাতঘড়ি তখন বলছে, বিকেল ৩টে। তপনবাবুদের ঘরের দেওয়ালেও একটা ঘড়ি রয়েছে। তবে তা সাড়ে ৫টা বেজে বন্ধ হয়ে রয়েছে। সে কথা জানাতেই তপনবাবু হাসতে হাসতে বললেন, ‘‘কাউকে কথা দেওয়া থাকলেই শুধু সময়ের দরকার পড়ে। না হলে আমাদের সব সময় একই রকম!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন