ডায়মন্ড কাটার মেশিন দিয়ে কাটা হচ্ছে বিবেকানন্দ উড়ালপুলের কংক্রিট। শনিবারের নিজস্ব চিত্র।
মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে গড়া কমিটিতে খড়্গপুর আইআইটি-র বিশেষজ্ঞরা তো আছেনই। উড়ালপুল বিপর্যয়ের পুলিশি তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে এ বার বিশেষজ্ঞ সংস্থার সাহায্য চাইলেন কলকাতার গোয়েন্দারা। লালবাজারের আর্জি মেনে শনিবারই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে নির্মাণ বিশেষজ্ঞ সংস্থা ‘রাইটস’-এর প্রতিনিধিদল।
গোয়েন্দারা গোড়াতেই বলেছিলেন, বিবেকানন্দ রোডের নির্মীয়মাণ উড়ালপুল কেন ভেঙে পড়ল, সেই ব্যাপারে বিশেষজ্ঞের মত ছাড়া তদন্তে এগোনো যাবে না। ভেঙে পড়ার কারণ থেকেই অনেকটা বোঝা সম্ভব, বিপর্যয়ের পিছনে কে বা কারা দায়ী। সেই কারণেই রাইটস-এর সাহায্য চেয়ে তাদের চিঠি লিখেছিল কলকাতা পুলিশ। রাইটস এখনও দায়িত্ব নেওয়ার কথা লিখিত ভাবে জানায়নি। তবে শনিবার তারা পোস্তা ঘুরে যাওয়ার পর লালবাজারের আশা, ইতিবাচক সাড়াই দিতে চলেছে ওই সংস্থা।
বিপর্যয়ের পরে রাজ্য সরকার অবশ্য অন্য বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি রাইটস-কেও সেতুর নক্শা পরীক্ষা করতে বলেছিল। রাজ্যকে দেওয়া প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্টে কাঁচামালের গুণমান ও নিরাপত্তার বন্দোবস্ত নিয়ে তারা প্রশ্ন তুলেছিল বলে সূত্রের দাবি। রাইটস এ নিয়ে মুখ খোলেনি। তবে তাদের এ বারের ভূমিকাটি আলাদা। এ ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল শুধুমাত্র কলকাতা পুলিশকেই জানাবে রাইটস। তাদের কাজ হবে অনেকটা গল্পের গোয়েন্দাদের সাহায্য করা বন্দুক বিশেষজ্ঞ বা শারীরবিদ্যার ‘প্রফেসর’-এর মতো।
এ দিন রাইটস-এর এক প্রতিনিধিদল উড়ালপুলে ব্যবহৃত ইস্পাত ও ইমারতি কাঠামো এক প্রস্ত খতিয়ে দেখেন। ছবিও তোলেন তাঁরা। সঙ্গে ছিলেন কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন) দেবাশিস বড়াল। রাইটস-এর এক কর্তা জানান, সেতুর ‘সফ্ট’ (ফেব্রিকেশন) ড্রয়িং চেয়ে পাঠানো হয়েছে। যা থেকে বোঝা যাবে, কী ধরনের ইস্পাত সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছিল। তার মান ঠিক ছিল কি না এবং তা পরীক্ষা করে কাজে লাগানো হয়েছিল কি না— খতিয়ে দেখা হবে সবই। বিশেষজ্ঞরা জানান, আরও ছবি তোলা হবে। উড়ালপুলের ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে নমুনা সংগ্রহ করবে রাইটস। সে সব পাঠানো হবে ন্যাশনাল টেস্ট হাউসে। রাইটস-এর এক উচ্চপদস্থ কর্তা জানান, সব কিছু দেখে রিপোর্ট দিতে তাঁদের মাসখানেক সময় লাগতে পারে।
নির্মাণকাজে শ্রমিক ও কাঁচামাল সরবরাহকারী রজত বক্সীর নাগাল অবশ্য এখনও পায়নি লালবাজার। ঘটনার পরে দশ দিন কেটে গিয়েছে। এ দিন সেতুর নির্মাতা সংস্থা ‘আইভিআরসিএল’-এর সিএমডি-র খোঁজে গোয়েন্দাদের একটি দল হায়দরাবাদে গিয়েছে। এখনও পর্যন্ত ওই সংস্থার ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু সিএমডি-কে নোটিস পাঠিয়ে ডাকা হলেও তিনি আসেননি।
একই ভাবে অধরা স্থানীয় তৃণমূল নেতা সঞ্জয় বক্সীর ভাইপো রজতও। ঘটনার দু’দিন পরেই লালবাজারের কর্তারা বলেছিলেন, রজতের খোঁজ চলছে। কিন্তু পুলিশের নিচু ও মাঝারিতলার বহু কর্মীর দাবি, রজতকে গ্রেফতার করার কোনও নির্দেশ উপরতলা থেকে এখনও আসেনি। তদন্তকারীদের একাংশের বক্তব্য, শ্রমিক জোগান দেওয়ার পাশাপাশি সিমেন্ট, বালি, স্টোনচিপসও সরবরাহ করতেন রজত। আইভিআরসিএল-এর রেডিমিক্স প্লান্ট এবং তাদের কসবা ও বিডন স্ট্রিটের অফিস থেকে বাজেয়াপ্ত হওয়া রসিদ পরীক্ষা করেছেন তদন্তকারীরা। তাঁদের দাবি, শুধু রজত নন, তাঁর স্ত্রীর মালিকানাধীন একটি সংস্থার নামেও বালি সরবরাহের চালান কাটা হয়েছে।
কর্তব্যে গাফিলতির যথেষ্ট ইঙ্গিত সত্ত্বেও কেএমডিএ-র কাউকে এখনও গ্রেফতার করা হয়নি। লালবাজারের দাবি, কেএমডিএ-র এক-এক জন কর্তার হাতে এক-একটি বিভাগের দায়িত্ব ছিল। এখনও নিশ্চিত করা যায়নি, ঠিক কোন বিভাগের উড়ালপুল ভেঙেছে। সে বিষয়ে দিশা পেতেই রাইটস-কে ডাকা।
খড়্গপুর আইআইটি-র দু’জন ইঞ্জিনিয়ার ইতিমধ্যেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। নবান্ন সূত্রের খবর, সেতুর যে অংশ ভেঙে পড়েছে, সেই ৪০ নম্বর পিলার দেখে বিশেষজ্ঞরা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। প্রাথমিক ভাবে তাঁদের মত, ওই জায়গায় দু’টি পিলারের প্রয়োজন ছিল। নবান্নের এক কর্তা জানান, ১৩ এপ্রিল মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে কমিটির দ্বিতীয় বৈঠক রয়েছে। সেখানেই আইআইটির বিশেষজ্ঞদের প্রাথমিক একটি রিপোর্ট পাওয়া যাবে।
এ দিন সকালে প্রায় ৪০ মিনিট ধরে উ়ড়ালপুলের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখে নির্মাণপদ্ধতিকেই দুষেছেন ত্রিপুরার রাজ্যপাল তথা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষক তথাগত রায়। তিনি বলেন, ‘‘আমি এখানে রাজনীতিবিদ হিসেবে আসিনি। নাটবল্টু ভেঙে যাওয়ার পরেও কেন জোর করে ঝালাইয়ের কাজ করা হয়েছিল? সঙ্গে সঙ্গে কাজ থামানো উচিত ছিল। যে ঝালাই করা হয়েছিল, তা-ও খুব নিম্ন মানের।’’
শুক্রবার থেকেই উড়ালপুলের ভেঙে যাওয়া অংশ সরানোর কাজে হাত দিয়েছে রেলওয়ে বিকাশ নিগম লিমিটেড (আরভিএনএল)। সংস্থার এক পদস্থ আধিকারিক বলেন, ‘‘ধাপে ধাপে উড়ালপুলের উপরের কংক্রিটের অংশ কাটার কাজ শুরু করেছি। সেই কাজে লাগানো হয়েছে বড় ক্রেন, ডায়মন্ড কাটার মেশিন। কংক্রিটের অংশ কাটার পর লোহার অংশ গ্যাস কাটার দিয়ে কাটা হবে।’’
‘উড়ালপুল হটাও অভিযান সমিতি’-র সম্পাদক বাপি দাস এ দিন বলেন, ‘‘সরকার যাতে
কোনও ভাবেই নতুন করে উড়ালপুল নির্মাণের কাজ শুরু করতে না পারে, সোমবার হাইকোর্টে আমরা সেই আবেদন জানাব।’’