COVID 19

অক্সিজেন ভরসা ছিল যাঁর, কোভিড রোগীর শ্বাস জোগাচ্ছেন তিনিই

অক্সিজেনের জন্য চরম হাহাকারের সময়ে গত এক মাস ধরে সেই মেয়েরই আর অক্সিজেন নলের প্রয়োজন পড়ছে না। বরং তাঁর অক্সিজেনের সরঞ্জামই প্রাণ বাঁচাচ্ছে একাধিক কোভিড রোগীর।

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০২১ ০৫:২০
Share:

বাড়িতে অভিষিক্তা ব্রহ্ম। —নিজস্ব চিত্র।

তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার সময়ে হাসপাতাল থেকে বলেছিল, এ মেয়ে আর বড় জোর ছ’মাস। চিকিৎসকেরা তাঁর মা-বাবাকে বলেছিলেন, “বাড়ি নিয়ে গিয়ে চেষ্টা করে দেখুন। অনেক সময়ে মিরাকলও তো হয়!” তার পরে সত্যিই যেন সেই অভাবনীয় ঘটনা ঘটছে বাঁশদ্রোণীর বছর আঠারোর অভিষিক্তা ব্রহ্মের জীবনে। গলায় ফুটো করে ঢোকানো অক্সিজেন নল ছাড়া যে তরুণীর এক মুহূর্ত চলত না, কোভিড পরিস্থিতিতে অক্সিজেনের জন্য চরম হাহাকারের সময়ে গত এক মাস ধরে সেই মেয়েরই আর অক্সিজেন নলের প্রয়োজন পড়ছে না। বরং তাঁর অক্সিজেনের সরঞ্জামই প্রাণ বাঁচাচ্ছে একাধিক কোভিড রোগীর।

Advertisement

অভিষিক্তার বাবা অরিন্দম ব্রহ্ম বলছেন, “কী করে মেয়ের এতটা উন্নতি হল বলতে পারব না। তবে ওর অক্সিজেন স্যাচুরেশন গত এক মাস ধরে ৮৮ শতাংশের আশেপাশে রয়েছে। এতেই ওর আর অক্সিজেন সাপোর্ট লাগছে না। এ দিকে প্রতিদিন অক্সিজেনের অভাবে মানুষ মারা যাচ্ছেন। তাই আমরা ঠিক করেছি, মেয়ের জন্য কেনা অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে শুরু করে অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর, অক্সিজেন মাস্ক, সাকশন মেশিন, নেবুলাইজ়ার সব কিছু নিয়েই মানুষের পাশে দাঁড়াব। মেয়ের
ওই সব জিনিস এখন কোভিড রোগীদের বাড়ি বাড়ি ঘুরছে।” আর অভিষিক্তার মা অনিন্দিতাদেবীর কথায়, “আমাদের মেয়ে তো জন্ম থেকে লড়াই করছে। ফলে জরুরি সময়ে এই সাহায্যটুকু যে কতটা প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায় তা জানি।”

কেমন লড়াই? অরিন্দমবাবু জানাচ্ছেন, নির্ধারিত সময়ের আগেই জন্মেছিলেন অভিষিক্তা। চিকিৎসায় জানা যায়, সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত তিনি। এর পরে হুইলচেয়ারে আবদ্ধ হয়ে যায় অভিষিক্তার জীবন। সেই নিয়েই ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সেরিব্রাল পলসি-তে পড়াশোনা চলতে থাকে তাঁর। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত সহকারী নিয়ে পরীক্ষা দিয়ে ৯০ শতাংশ নম্বর পেয়ে পাশ করলেও সেই চলার পথে বাধ সাধে একের পর এক খিঁচুনি (কনভালশন)। এর সঙ্গেই ধরা পড়ে যে, শিরদাঁড়ার সমস্যাও (স্কোলিয়োশিস) রয়েছে অভিষিক্তার। শরীর ক্রমশ বাঁ দিকে বেঁকে যেতে শুরু করে। ২০১৪ সালের খিঁচুনির পরে কোমায় চলে যান অভিষিক্তা। বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতাল তাঁকে কোমা থেকে বার করতে পারলেও ৪৫ দিনের মাথায় ছুটি দিয়ে জানায়, আর মাত্র ছ’মাস সময় রয়েছে অভিষিক্তার হাতে।

Advertisement

বাড়ি ফিরে আসার ঠিক এক বছরের মাথায় ফের খিঁচুনি হয় অভিষিক্তার। এর জেরে ভেলোরে অস্ত্রোপচারের তারিখ পাকা হয়ে গেলেও তা আর করা যায়নি। এ বার জরুরি হয়ে পড়ে ভেন্টিলেশনের। অরিন্দমবাবু বললেন, “বেসরকারি হাসপাতালে এক এক দিনে ৩০ হাজার টাকা বিল হচ্ছিল। অনেক ঘুরে শেষে মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের চিঠি নিয়ে আর কয়েক জন সহৃদয় ব্যক্তির সাহায্যে মেয়েকে এসএসকেএমে ভর্তি করাতে পারি।” সেখানেই সিসিএম (ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন) বিভাগের পাঁচ নম্বর শয্যায় শুরু অভিষিক্তার নতুন লড়াই। যদিও এর মধ্যে দু’চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন অভিষিক্তা। নার্ভ এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ে যে, হাত পা নাড়ানো তো দূরের কথা, গায়ে মশা-মাছি বসলেও তাড়াতে পারেন না তিনি। এর মধ্যেই গলার কাছে ছিদ্র করে ঢোকানো হয় অক্সিজেন নল।

এসএসকেএমে এই যুদ্ধেও জয়ী হন অভিষিক্তা। দীর্ঘ ১১ মাস পরে ভেন্টিলেশন থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি। যদিও চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন, হাসপাতালে প্রচুর রোগীর চাপ। সিসিইউ শয্যা ছেড়ে দিতে হবে অভিষিক্তাকে। ফলে বাধ্য হয়ে বাড়ির একটি ঘরেই মেয়ের জন্য ছোটখাটো হাসপাতাল বানিয়ে ফেলেন অভিষিক্তার বাবা-মা। ব্যবস্থা করতে হয় ফাউলার বেড (হাসপাতালের শয্যা), অক্সিজেন সিলিন্ডার, অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর, সাকশন যন্ত্র, নেবুলাইজ়ারের মতো অনেক সরঞ্জামেরই। অরিন্দমবাবুর এক বন্ধু তাঁর মায়ের মৃত্যুর পরে তাঁর জন্য কেনা অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর দিয়ে দেন অভিষিক্তাকে। এর বেশির ভাগই এখন লাগছে কোভিড রোগীদের প্রাণ বাঁচানোর কাজে।

যেমন, গত ২৫ এপ্রিল অভিষিক্তাদের প্রতিবেশী এক বয়স্ক দম্পতির সংক্রমিত হওয়ার খবর জানা যায়। কোভিড রিপোর্ট না থাকায় সে সময়ে ৭২ বছরের ওই বৃদ্ধ ও তাঁর ৬৫ বছরের স্ত্রী-কে ভর্তি নিতে চাইছিল না কোনও হাসপাতাল। অথচ বৃদ্ধ ও বৃদ্ধার শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ নেমে গিয়েছিল যথাক্রমে ৭০ এবং ৩৫-এ! সেই খবর পেয়ে দ্রুত অভিষিক্তার অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর ওই দম্পতির বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন অরিন্দমবাবু। অভিষিক্তাকে সাহায্য করা এক নার্সও চলে আসেন খবর পেয়ে। তবে এক সময়ে ওই বয়স্ক দম্পতির অবস্থার এতটাই অবনতি হয় যে, কাকে ছেড়ে কাকে অক্সিজেন দেওয়া হবে, তা স্থির করা যাচ্ছিল না। দীর্ঘ লড়াইয়ের পরে অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটরের সাহায্যে দু’জনের শরীরেই অক্সিজেনের মাত্রা কিছুটা বাড়ে। যদিও পরে হাসপাতালে শয্যা পাওয়া গেলেও বৃদ্ধাকে আর বাঁচানো যায়নি। বৃদ্ধ এক হাসপাতালে এখনও চিকিৎসাধীন।

আর অভিষিক্তা? এই কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পাশে থাকতে পারার অনুভূতি কি বোঝাতে পারেন তিনি?

শয্যাশায়ী মেয়ের মা বললেন, “ওকে আমরা বলেছি, তোমার তো অক্সিজেন এখন লাগছে না, অন্যদের দিই? মেয়ে কথা বলতে পারে না। তবে ওর যে আপত্তি নেই, ঠোঁট নাড়িয়ে এক ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে। সব হাসপাতালই যার ডেথ সার্টিফিকেট প্রায় লিখে দিয়েছিল, সে-ই এখন অন্যদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন