দ্বন্দ্বমূলক তৃণমূলবাদ

পিটিয়ে চলন্ত ট্রেনের মুখে ফেলা হল যুবককে

বাম আমলে বিরোধী সমর্থকদের চেপে ধরে মুখে জ্যান্ত কইমাছ ছেড়ে দেওয়া কিংবা হাতের পাঞ্জা কেটে নেওয়ার মতো অত্যাচারের অভিযোগ এনেছে তৃণমূল। এ বার ভোটের মুখে খাস কলকাতায় এক যুবকের মাথায় বাঁশ মেরে বেহুঁশ করে রেল লাইনে ফেলে রাখার অভিযোগ উঠল তৃণমূলেরই বিরুদ্ধে। যুবকের দু’টো পা-ই চলন্ত ট্রেনে কাটা পড়েছে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৬ ০৩:৫৪
Share:

দু’টো পা-ই কাটা। হাসপাতালে রাহুল রায়। — রণজিৎ নন্দী

বাম আমলে বিরোধী সমর্থকদের চেপে ধরে মুখে জ্যান্ত কইমাছ ছেড়ে দেওয়া কিংবা হাতের পাঞ্জা কেটে নেওয়ার মতো অত্যাচারের অভিযোগ এনেছে তৃণমূল। এ বার ভোটের মুখে খাস কলকাতায় এক যুবকের মাথায় বাঁশ মেরে বেহুঁশ করে রেল লাইনে ফেলে রাখার অভিযোগ উঠল তৃণমূলেরই বিরুদ্ধে। যুবকের দু’টো পা-ই চলন্ত ট্রেনে কাটা পড়েছে। তাঁর বাড়ির লোকজনের দাবি, শাসক দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরেই ঘটনাটি ঘটেছে।

Advertisement

শনিবার রাত তিনটে নাগাদ এন্টালি এলাকায় শিয়ালদহের এক নম্বর রেলসেতুর নীচে রাহুল রায় নামে বছর তিরিশের ওই যুবকের রক্তাক্ত ও অচৈতন্য দেহ উদ্ধার করা হয়। স্থানীয় মানুষ দেখেন, তাঁর বাঁ পা হাঁটুর নীচ থেকে কেটে চলে গিয়েছে আর ডান পা গোড়ালি থেকে কাটা। রাহুলকে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। পুলিশের একটি সূত্রের খবর, তাঁর একটি পা থেঁতলানো অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে, পাওয়া গিয়েছে একপাটি চটি। অন্য পায়ের খোঁজ মেলেনি। ট্যাংরার দেবেন্দ্রচন্দ্র দে রোডের বাসিন্দা রাহুল একটি হোটেলে কাজ করেন। তিনি খুনের মামলায় জেলবন্দি তৃণমূল নেতা শম্ভুনাথ কাওয়ের ঘনিষ্ঠ তৃণমূল কর্মী বলে পরিচিত।

রাহুলের দাদা জগ্গু রায়ের অভিযোগ, ‘‘পাড়ার দুই পরিচিত সমাজবিরোধীর দলবল এই ঘটনা ঘটিয়েছে। ওরা স্বর্ণকমল সাহা আর স্বপন সমাদ্দারের লোক। এদের সিপিএম থেকে তৃণমূলে আনা হয়েছে। এই ঘটনায় প্রদীপ গুহও জড়িত।’’

Advertisement

স্বপন সমাদ্দার ৫৮ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল পুরপিতা। স্বর্ণকমল সাহা এন্টালির তৃণমূল বিধায়ক। দু’জনের কেউই এই ঘটনায় তাঁদের অনুগামীরা কেউ জড়িত বলে মানতে চাননি। স্বপনবাবুর বক্তব্য, ‘‘যে ছেলেটি আহত, আমি তো তাঁকে চিনিই না। শম্ভুনাথ কাওয়ের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুব ভাল। তা হলে আমার নাম জড়িয়ে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের প্রসঙ্গ উঠছে কেন?’’ স্বর্ণকমলবাবু আবার আহত যুবককে ‘নেশাখোর ছেলে’ বলে দাবি করেছেন। তাঁর কথায়, ওই যুবক নিজেই নেশা করে রেললাইনে এসে পড়েছিলেন। নিজের অনুগামী বলে পরিচিত প্রদীপ গুহের বিরুদ্ধে ওই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ কার্যত উড়িয়ে দিয়ে স্বর্ণকমলবাবু বলছেন, ‘‘প্রদীপ আমাদের দলের ছেলে। স্থানীয় তৃণমূল নেতা। নির্বাচনের সময়ে সব ঘটনাতেই রাজনৈতিক রং লাগানোর চেষ্টা হচ্ছে।’’ রাহুল সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য, ‘‘যে ছেলেটির কথা বলা হচ্ছে, সে তো এলাকারই নয়। মাঝেমধ্যে এসে গণ্ডগোল করে বলে শুনেছি।’’

রাহুলের পরিবার কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য কথাই বলছে। রাহুলের স্ত্রী গুড়িয়ার (ছবি তেরোর পাতায়) বক্তব্য, ‘‘ও সব সময়ে শম্ভুনাথ কাওয়ের সঙ্গে থাকত। দলের অন্য গোষ্ঠীর লোকজন আমার স্বামীকে টার্গেট করেছে। উনি (শম্ভুনাথ) জেলে গিয়েছেন, আমাদের সব শেষ হয়ে গিয়েছে।’’ এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরেই রাহুল দেড় বছর যাবৎ এলাকাছাড়া বলেও জানাচ্ছেন তাঁর বাড়ির লোকজন। ইদানীং রাহুল বেলেঘাটার একটি ঝুপড়িতে থাকতেন আর মাঝেমধ্যে বাড়িতে আসতেন রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে। যেমন এসেছিলেন শনিবার রাতে।

বাড়ির লোকজন জানান, স্ত্রী গুড়িয়া ও পাঁচ বছরের মেয়ে খুশি অসুস্থ শুনে শনিবার রাত এগারোটা নাগাদ ট্যাংরায় নিজের বাড়িতে এসেছিলেন রাহুল। তার পর মোটর সাইকেলে করে বেলেঘাটার উদ্দেশে রওনা হয়ে যান। পথের মধ্যেই শাসক দলের অন্য গোষ্ঠীর লোকেরা রাহুলকে মাথায় বাঁশ দিয়ে মেরে অজ্ঞান অবস্থায় পরিকল্পিত ভাবে রেললাইনে শুইয়ে দেয় বলে অভিযোগ।


অঙ্কন: সুমন চৌধুরী

রাহুলের স্ত্রীর কথায়, ‘‘আমার স্বামীকে মাথায় মেরে অজ্ঞান করে রেললাইনে এমন ভাবে ফেলে রাখা হয়, যাতে ট্রেনে কাটা পড়লে দুর্ঘটনা বলে চালানো যাবে।’’ দাদা জগ্গুর দাবি, ‘‘রাহুলের পায়ের উপর দিয়ে ট্রেন চলে যাওয়ার পর ওকে রেলব্রিজের উপর থেকে ফেলে দেয় ওরা।’’ নইলে, পরিবারের প্রশ্ন, রেলে পা কাটা পড়ার পরে রাহুল রেলসেতুর নীচে এলেন কী করে। অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে, তাদের অন্যতম প্রদীপ গুহের নামে পুরনির্বাচনেও সমাজবিরোধী কাজকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল বলে পুলিশ সূত্রের খবর। নির্বাচনী মরসুমে সমাজবিরোধী দাপাদাপি ফের বাড়ছে বলে বাসিন্দাদেরও অভিযোগ।

এ দিন দুপুরে গিয়ে দেখা গেল, এনআরএস হাসপাতালের শয্যায় রাহুল শুধু মাঝেমধ্যে চোখ মেলে ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছেন। মাথায় আর পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা। কথা বলার অবস্থায় তিনি নেই। তাঁর দাদার অভিযোগের ভিত্তিতে শিয়ালদহ রেল পুলিশ তদন্তে নেমেছে। শনিবার রাতের ট্রেনের কোনও চালক কিছু দেখেছিলেন কি না, সেটাও খোঁজ করা হচ্ছে। রাহুলকে রক্তাক্ত অবস্থায় যে এলাকা থেকে পাওয়া গিয়েছে এবং তাঁর বাড়ি যেখানে, দু’টোই এন্টালি বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। রাহুলের পরিবারের অভিযোগ, মাঝেমধ্যেই শাসক দলের অন্য গোষ্ঠীর তরফে তাঁদের শাসানো হতো। ‘‘পুলিশকে আগেও সব জানানো হয়েছে। তবু ওঁরা কিছুই করেন না।’’ ডিসি (ইএসডি) গৌরব শর্মার যদিও দাবি, ‘‘লিখিত অভিযোগ পেলে সব সময়েই গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়।’’


অসহায় কান্না তৃণমূল কর্মী রাহুল রায়ের দু’টি পা কাটা
পড়ার খবর শোনার পরে হাসপাতালে তাঁর স্ত্রী
-কন্যা
ছবি
: রণজিৎ নন্দী।

বালির তপন দত্ত থেকে শুরু করে বাগুইআটির সঞ্জয় রায় ওরফে বুড়ো— তৃণমূল শাসনে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে বোমাবাজি, গুলি করে খুনের অভিযোগ নতুন কিছু নয়। কিন্তু বীভৎসতার বিচারে রাহুলের ঘটনা নজিরবিহীন বলে মানছে পুলিশের একাংশও। শহরের বুকে শাসক দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এই রকম নৃশংস চেহারা নিলে দল কী ব্যবস্থা নেবে? তৃণমূল মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ঘটনাটা সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছি। তার আগে কিছু বলতে পারব না।’’

রাজ্য জুড়ে বিধানসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। শহরে টহল দিচ্ছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। তারই মধ্যে এমন ঘটনা যে ঘটতে পারল, তা দেখে রীতিমতো আশঙ্কিত বিরোধী নেতারা। সিপিএম রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘এ তো জঙ্গলের রাজত্ব। তৃণমূলের বড় তোলাবাজ তার প্রতিপক্ষকে রেললাইনে ফেলে দিল!’’ কংগ্রেস নেতা আবদুল মান্নানের আক্ষেপ, ‘‘কোনও রাজনৈতিক দলকে যদি নিকৃষ্ট জীবরা নিয়ন্ত্রণ করে, তা হলে এই পরিণতিই হয়।’’ বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যেরও বক্তব্য, ‘‘এদের রাজনৈতিক কর্মী বললে রাজনীতিকেই অপমান করা হয়। বাংলার দুর্ভাগ্য যে, শাসক দল এদের উপরেই নির্ভরশীল।’’

অঙ্কন: সুমন চৌধুরী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন