বিশেষ ধরনের দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত যুবককে চিকিৎসায় সারিয়ে তুলে আক্ষরিক অর্থেই নতুন জীবন দিয়েছিলেন সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা। ১৪ বছর আগে এই শহরে নতুন জীবন পাওয়া সেই বিহারী যুবক মাঝখানে অনেকটা সময়ের জন্য শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন নিজের রাজ্যে। এখন তাঁর অসুস্থ বন্ধুকে নিয়ে ফের এখানকার সরকারি হাসপাতালেরই দ্বারস্থ হয়েছেন তিনি। ডাক্তারবাবুরা ফের কোনও ‘ম্যাজিক’ করবেন, সেই আশায়। সরকারি হাসপাতালের পরিষেবা নিয়ে যখন চারপাশে অভিযোগের শেষ নেই, তখন এই ঘটনাটিকেই রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ‘শো-কেস’ হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন স্বাস্থ্যকর্তারা।
সালটা ২০০২। তখনও সরকারি হাসপাতালে ক্যানসার নির্ণয়ের আধুনিক যন্ত্র আসেনি। চালু হয়নি আধুনিক চিকিৎসাও। কেমোথেরাপি-রেডিওথেরাপি ফ্রি হওয়া তখনও বহু দূরের গল্প। সেই সময়েই অস্টিও-সার্কোমা নিয়ে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছিলেন ২৩ বছরের দিলীপ চৌধুরী।
বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, অস্টিও সার্কোমা হাড়ের এক ধরনের ক্যানসার, যা দ্রুত অন্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে অবস্থার অবনতি ঘটায়। এই ধরনের ক্যানসারে মৃত্যু-হারও খুব বেশি। অঙ্গ বাদ দেওয়ার অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি— সব কিছু দ্রুত সেরে ফেলার পরেও বহু ক্ষেত্রেই দুই থেকে পাঁচ বছরের বেশি বাঁচানো যায় না রোগীকে।
দিলীপবাবুর পায়ে অস্টিও সার্কোমা হয়েছিল। সেই সময়ে কলকাতার জোড়াবাগান অঞ্চলে থাকতেন তিনি। কলকাতায় রোগটা ধরা পড়ার পরে চলে যান মুম্বইয়ের টাটা ক্যানসার হাসপাতালে। সেখানেও একই রিপোর্ট। চিকিৎসকেরা জানান, পা-টি অবিলম্বে বাদ দিতে হবে। কলকাতায় ফিরে পৌঁছে যান কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে ডাক্তারদের সরাসরি জানিয়েছিলেন, পা বাদ দিয়ে বাকি জীবনটা পঙ্গু হয়ে কাটাতে রাজি নন। তাঁর জেদটাকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেন ডাক্তারবাবুরা। পা বাদ না দিয়ে শুধু টিউমারের অংশটুকু কুরে বাদ দেওয়া হয়। তার পর চলে কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি। দীর্ঘ চিকিৎসার পরে কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি।
কলকাতা মেডিক্যালের ক্যানসার বিভাগের তৎকালীন প্রধান চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘অতগুলো বছর আগে তো সরকারি হাসপাতালে এত উন্নত চিকিৎসা ছিল না। আমরা রীতিমতো চর্চা চালিয়েছিলাম, ঠিক কী কী ওষুধ দিলীপের উপরে প্রয়োগ করা যায়। টানা কয়েক মাস চিকিৎসা চলেছিল। তার পরে নিয়মিত ফলো-আপ করতে বলা হয়েছিল। কারণ এই রোগটা অত্যন্ত বেয়াড়া।’’ কিন্তু কিছু দিন ফলো-আপ করার পরেই বেপাত্তা হয়ে যান দিলীপ। ‘‘খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমরা খারাপ পরিণতিটাই ধরে নিয়েছিলাম,’’ বলেন সুবীরবাবু। আপাতত আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের ক্যানসার বিভাগের দায়িত্বে রয়েছেন তিনি। দিন কয়েক আগে দিলীপ যোগাযোগ করেন তাঁর সঙ্গে।
এত দিন কোথায় ছিলেন? দিলীপ জানালেন, বিহারে নিজের বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন বেশ কিছু দিনের জন্য। তার পরে কলকাতায় ফেরেন। কিন্তু শরীর তখন এতটাই চাঙ্গা যে, হাসপাতালে যাওয়ার কথা মাথাতেই আসেনি। তা হলে এখন কেন এলেন? তিনি বলেন, ‘‘এক বন্ধুর ক্যানসার। বিহার থেকে ওকে নিয়ে এসেছি এই শহরে। যে ডাক্তারবাবুরা আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন, তাঁরা ওকেও দিতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।’’
প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্র জানিয়েছেন, অত বছর আগেই কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ক্যানসারের সামগ্রিক চিকিৎসা শুরু করার চেষ্টা হয়েছিল। বহু রোগী তার সুফল পেয়েছেন। অন্য দিকে, বর্তমান স্বাস্থ্যকর্তারা দিলীপবাবুর এই উদাহরণটিকে সামনে এনে সরকারি হাসপাতালের সাফল্যকে তুলে ধরতে চাইছেন। তাঁদের বক্তব্য, দেশের যে কোনও প্রান্তের চিকিৎসকদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেন এ রাজ্যের সরকারি চিকিৎসকেরা। কোনও বিজ্ঞাপন প্রয়োজন নেই, স্রেফ রোগীদের মুখে-মুখেই ছড়িয়ে পড়ছে তাঁদের কথা। আর সুবীরবাবুর ব্যাখ্যা, ঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করে দ্রুত সঠিক চিকিৎসাটা শুরু করতে পেরেছিলেন তাঁরা। বহু ক্ষেত্রেই সেটা হয়, কিন্তু তাতে ফল সব সময়ে আশানুরূপ হয় না। কিন্তু দিলীপের ক্ষেত্রে সেটাই ম্যাজিকের মতো কাজ করেছিল। বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার সম্পর্কে প্রচলিত আতঙ্কের ‘মিথ’টাও এ ক্ষেত্রে ভেঙেছে তাতেই।