ঘটা করে প্রচারই সার, অবাধ্য চালককে রুখবে কে

ফুটপাথে বেপরোয়া বাস, মাসুল গুনলেন পথচারী

রবিবার সকালে হাফ ম্যারাথন দিয়ে পথ নিরাপত্তা সপ্তাহের উদ্বোধন করেছিলেন পুলিশকর্তারা। ওই দিনই ধাপার কাছে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি ট্যাক্সি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছে ধাক্কা মারায় মৃত্যু হয় মহম্মদ রেহান (২২) নামে এক যাত্রীর।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০১৮ ০২:২৮
Share:

অমানবিক: গুরুতর আহত অবস্থায় ফুটপাথে পড়ে কাতরাচ্ছেন পথচারী। প্রত্যক্ষদর্শীরা তখন ব্যস্ত পরিস্থিতি ক্যামেরা বন্দি করতেই। জখমের সাহায্যে পাশে শুধু এক জনই। সোমবার, স্ট্র্যান্ড রোডে। —নিজস্ব চিত্র

সকালে ঢাকঢোল পিটিয়ে পথ নিরাপত্তা সপ্তাহ শুরু করেছিল কলকাতা পুলিশ। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শহরের পথে নিরাপত্তার অভাব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল দু’টি বাস। পুলিশ জানিয়েছে, সোমবার সাড়ে বারোটা নাগাদ মিলেনিয়াম পার্কের সামনে দুই বেপরোয়া বাসের সংঘর্ষে অন্তত পাঁচ জন আহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আহত হয়েছেন অনুপ সামন্ত নামে বছর বাহান্নর এক পথচারী। তাঁর দু’টি পা-ই বাদ দিতে হতে পারে বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন। ঘটনার পরেই মিনিবাসের চালক ও খালাসি বাস ফেলে চম্পট দেয়। রাত পর্যন্ত তাদের ধরতে পারেনি পুলিশ।

Advertisement

বস্তুত, রবিবার সকালে হাফ ম্যারাথন দিয়ে পথ নিরাপত্তা সপ্তাহের উদ্বোধন করেছিলেন পুলিশকর্তারা। ওই দিনই ধাপার কাছে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি ট্যাক্সি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছে ধাক্কা মারায় মৃত্যু হয় মহম্মদ রেহান (২২) নামে এক যাত্রীর। পথ নিরাপত্তা সপ্তাহেও যে সচেতনতা এবং নজরদারি জোরালো হয়নি তা জানা গিয়েছে লালবাজার সূত্রেই।

পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, মিনিবাসটির চাকা রিসোলিং করা ছিল। তার ফলেই ব্রেক ঠিক মতো ধরেনি। বেআইনি ভাবে রিসোলিং করা চাকা নিয়ে কী ভাবে বাসটি চলছিল, তা নিয়েও তদন্ত শুরু হয়েছে।

Advertisement

আরও পড়ুন: গতি কমাতে দায় থাকে যাত্রীদেরও

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, রবীন্দ্রনগর থেকে মিনিবাসটি স্ট্র্যান্ড রোড ধরে হাওড়ার দিকে দ্রুত বেগে ছুটছিল। মিলেনিয়াম পার্কের মূল গেটের সামনে বাসটি পৌঁছতেই ব্যাঙ্কশাল কোর্টের দিক থেকে আর একটি বাস ডান দিকে ঘুরে স্ট্র্যান্ড রোডে চলে আসে। সংঘর্ষ এড়াতে মিনিবাসটি বাঁ দিকের ফুটপাথে উঠে গিয়ে একটি গাছে ধাক্কা মারে। সেই সময়ে গাছের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন পূর্ব বর্ধমানের বাসিন্দা অনুপ সামন্ত। গাছ ও বাসের মধ্যে পিষে যান অনুপবাবু। তাঁর শরীরের নীচের অংশ ঢুকে যায় বাসের তলায়। পূর্ব রেলের সমবায় ব্যাঙ্কের ডেসপ্যাচ বিভাগের ওই কর্মীকে আশেপাশের লোকজন বাসের তলা থেকে বের করেন। প্রথমে তাঁকে এসএসকেএম ও পরে একবালপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।

পোস্টারে, ফেস্টুনে ‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’-এর প্রচার চলছে। কিন্তু গাড়িচালকদের হুঁশ কি ফিরেছে? অনেকেই বলছেন, গাড়িচালকদের হুঁশ ফেরেনি। উল্টে আইন মেনে ফুটপাথ দিয়ে হেঁটেও খেসারত দিতে হল এক নাগরিককে। কেন এমন হবে তার সদুত্তর মেলেনি। কলকাতা পুলিশের ডিসি (ট্র্যাফিক) সুমিত কুমার বলেন, ‘‘এত প্রচারের পরে এমন ঘটনা কাম্য নয়। তবে সচেতনতা যে একেবারেই বাড়ছে না সেটাও বলা যাবে না। যাঁরা আইন মানছেন না তাঁদের বিরুদ্ধে ক়ড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

দুর্ঘটনার পরে অনুপবাবুকে উদ্ধার করতে গিয়ে আঁতকে উঠেছেন অনেকেই। ওই এলাকার চায়ের দোকানি মহম্মদ লালু বলেন, ‘‘হঠাৎই দেখলাম বাসটি গাছে ধাক্কা মারল। বাসের তলা থেকে কাতরানোর শব্দ শুনে সকলে ছুটে যাই। তার পরে ওঁকে সেখান থেকে বের করে দেখি পা দুটোর কিছু অবশিষ্ট নেই!’’

মিনিবাসটি যে বেপরোয়া গতিতে চলছিল তা জানিয়েছেন যাত্রীরাও। তাঁদেরই এক জন শেখ জাকির হোসেন বলেন, ‘‘চালক হেস্টিংস থেকেই গতি বাড়িয়ে দেয়। আমাদের আপত্তি শোনেনি।’’ এসএসকেএমে স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞকে দেখিয়ে ওই বাসে উঠেছিলেন পূর্ব মেদিনীপুরের ভগবানপুরের বাসিন্দা ফয়জান বিবি। তিনি বলছেন, ‘‘বাসটি খুব জোরে ছুটছিল। হঠাৎ তীব্র ঝাঁকুনি, আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফিরতে দেখি, ইঞ্জিনের উপর পড়ে রয়েছি।’’

দুর্ঘটনার পর অনুপবাবুকে এসএসকেএমে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেখানকার পরিষেবা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তাঁর পরিজনেরা। অনুপবাবুর এক সহকর্মী বলেন, ‘‘এসএসকেএমে বলা হল ছ’ঘণ্টার মধ্যে কিছু একটা করতে হবে। অথচ পরিকাঠামোর দোহাই দিয়ে বলা হল অপারেশন হতে পারে বৃহস্পতিবার! পরোক্ষে যেন অন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতেই বললেন ওঁরা।’’ এর পরেই এসএসকেএম থেকে একবালপুরের বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয় অনুপবাবুকে। এসএসকেএমের এক কর্তা অবশ্য এ দিন বলেন, এমন কোনও অভিযোগ তাঁরা পাননি।

এদিন বেসরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগের শয্যায় শুয়ে কাতরাচ্ছিলেন অনুপবাবু। দু’পায়ে ব্যাণ্ডেজ জড়ানো। বলছিলেন, ‘‘আমি আর বাঁচব না। মরে যাব। আমার পরিবারকে তোমরা দেখো।’’ বাবার দুর্ঘটনার খবর শুনে হাজির হন কলেজপড়ুয়া ছেলে চিত্রম সামন্ত।

পুলিশের একাংশ বলছেন, পথ নিরাপত্তা সপ্তাহ চলছে। অথচ মিনিবাসটি বেশ কিছুটা পথ বেপরোয়া গতিতে চললেও তা ট্র্যাফিক পুলিশের নজরে এল না কেন? তা হলে কি রাস্তায় নজরদারি যথেষ্ট কড়া ছিল না? ট্র্যাফিক পুলিশ সূত্রের দাবি, রাস্তায় নজরদারি চলে। এ ছাড়া
পরমা উড়ালপুল-সহ অনেক জায়গাতেই সিসিটিভি ও গতি মাপার যন্ত্র বসানো রয়েছে। তাতে বেপরোয়া গাড়ি ধরা পড়লে জরিমানার চিঠিও পাঠানো হয়।

কিন্তু জরিমানা তো পরের ব্যাপার। এমন দুর্ঘটনায় আম-নাগরিকের ক্ষতি হলে তার খেসারত কে দেবে?

প্রশ্ন আছে, সদুত্তর নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন