লোকসভা ভোটের আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে থেকে কলকাতার কিছু জায়গায় গোলমাল ছড়িয়েছিল। তা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভোটগণনা ও পরবর্তী পর্যায়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আঁটোসাটো করতে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে কলকাতা পুলিশ। নিরাপত্তার স্বার্থে আজ, শুক্রবার থেকে শহরে অতিরিক্ত প্রায় চার হাজার পুলিশকর্মী মোতায়েন করা হবে বলে লালবাজার জানিয়েছে।
বস্তুত ফল বেরোনোর পরে মহানগরের জায়গায় জায়গায় অশান্তির আশঙ্কা করছেন পুলিশকর্তারা। বেলেঘাটা, কাশীপুর, যাদবপুরের মতো কিছু এলাকা নিয়ে তাঁরা বিশেষ উদ্বিগ্ন। এ ব্যাপারে স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের গোয়েন্দারা লালবাজারে রিপোর্টও পাঠিয়েছেন। বৃহস্পতিবার কলকাতা পুলিশের এক শীর্ষ-কর্তা বলেন, “ভোটের ফল বেরোলে গোলমালের আশঙ্কা রয়েছে। তাই কিছু জায়গায় বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”
দক্ষিণ শহরতলির সংযোজিত এলাকায় গণ্ডগোলের আগাম ইঙ্গিত ছিল ভোটের আগেই। তা সত্ত্বেও অশান্তি ঠেকানো যায়নি। পাশাপাশি গত ক’দিনে উত্তর ও পূর্ব কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলও নানাবিধ ঘটনায় তপ্ত হয়ে উঠেছে। গত রবিবার কাশীপুরে এক সিপিএম নেতার উপরে হামলা হয়। বেলেঘাটাতেও শাসকদলের বিরুদ্ধে লাগাতার হামলার অভিযোগ তুলছে বিরোধীরা।
এমতাবস্থায় গণনা-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখাটা পুলিশের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। এ দিন লালবাজার-সূত্রের খবর: কলকাতার আটটি গণনাকেন্দ্রের একশো মিটার চৌহদ্দিতে ১৪৪ ধারা জারি হয়েছে। মোতায়েন হচ্ছে অতিরিক্ত বাহিনী। আজ প্রতি গণনাকেন্দ্রের ভিতরে ও বাইরে এক প্ল্যাটুন করে কেন্দ্রীয় বাহিনী রাখা হবে। থাকবেন স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের গোয়েন্দারা। নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম, হেস্টিংস ও বিজয়গড় কলেজের গণনাকেন্দ্রের দায়িত্বে থাকছেন কলকাতা পুলিশের দু’জন করে ডিসি। অন্যান্য কেন্দ্রে এক জন করে ডিসি। কোথাও দরকার হলে তিন জন ডিসি-ও থাকতে পারেন। শহর জুড়ে দশটি হেভি রেডিও ফ্লাইং স্কোয়াড ও ৩৫টি রেডিও ফ্লাইং স্কোয়াড মোতায়েন রাখা হবে। বিভিন্ন প্রান্তে গোটা পঞ্চাশেক পুলিশ পিকেট বসানো হচ্ছে। থানাগুলোয় অতিরিক্ত বাহিনী ও স্ট্রাইকিং ফোর্স তৈরি থাকবে। খোলা হচ্ছে বিশেষ কন্ট্রোল রুম।
লালবাজারের কর্তারা জানিয়েছেন, কাশীপুর-বেলেঘাটা-যাদবপুরের পাশাপাশি এন্টালি-নারকেলডাঙা-উল্টোডাঙা-বেনিয়াপুকুর, বা বন্দরের মতো সংবেদনশীল এলাকায় নজরদারি বাড়াতে হচ্ছে। অন্য দিকে কাশীপুর-বেলেঘাটা বা যাদবপুরে যাতে নতুন করে উত্তাপ না-ছড়ায়, সে দিকেও পুলিশের কড়া নজর রয়েছে বলে কর্তাদের দাবি। প্রসঙ্গত, বুধবারই বেলেঘাটায় ফরওয়ার্ড ব্লকের এক কর্মী আক্রান্ত হয়েছেন।
এবং এ দিনও ওই সব অঞ্চল ছিল রীতিমতো থমথমে। পরিস্থিতি কী রকম? বেলেঘাটায় এ প্রশ্নের জবাবে পথচলতি মানুষ থেকে দোকানি কেউ রা কাড়েননি। দক্ষিণের কসবা, নেতাজিনগর, পাটুলিতেও তা-ই। সিপিএমের কয়েক জন জানিয়েছেন, হামলার ভয়ে তাঁরা একা রাস্তায় বেরোচ্ছেন না। ভোটপর্বে সবচেয়ে বড় গোলমাল বেঁধেছিল কাশীপুরে। রতনবাবু রোডে দুষ্কৃতী-হামলায় জখম হয়েছিলেন সিপিএমের লোকাল কমিটির সম্পাদক কল্যাণ সমাজদার। ওই ঘটনায় অভিযুক্তদের ‘আড়াল করার’ জন্য কাশীপুর থানার ওসি-র বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে তোপ দেগেছেন এক অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার। লালবাজার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে, কাশীপুরের ওই তল্লাটে পুলিশ পিকেটও বহাল। কিন্তু আতঙ্ক পুরো কেটেছে কি?
এ দিন দুপুরে ওখানে গিয়ে দেখা গেল, মোড়ে মোড়ে পুলিশ প্রহরা। আশপাশের দু’-একটা দোকানে গুটিকয়েক লোক। গোলমালের কথা জিজ্ঞাসা করতে তাঁরা সন্তর্পণে প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলেন। রতনবাবু রোডের ছোট চায়ের গুমটিতে বসে থাকা এক মাঝবয়সীর মন্তব্য, “রবিবারের পরে বড় ঝামেলা কিছু হয়নি ঠিকই। তবে ফল বেরোলে কী হবে, বলা যাচ্ছে না।”
এ দিকে শেষ মুহূর্তে গণনাকেন্দ্রগুলোয় চূড়ান্ত ব্যস্ততা। এ দিন দুপুরে নেতাজি ইন্ডোরে গণনাকর্মীরা পরিচয়পত্র নিতে লাইন দিয়েছিলেন। তাঁরা জানালেন, আজ সকাল আটটায় গণনা শুরু। কর্মীদের বলা হয়েছে সাতটার মধ্যে হাজির হতে। ভোর সাড়ে ছ’টায় শিয়ালদহ, হাওড়া স্টেশন-সহ বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কমিশনের বাস ছাড়বে। তাতে চাপিয়ে ওঁদের কেন্দ্রে কেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়া হবে।
ইভিএমগুলিকে ইন্ডোর স্টেডিয়ামের স্ট্রং রুম থেকে গণনাকক্ষ পর্যন্ত কী ভাবে বয়ে আনতে হবে, বিকেলে কর্মীদের তারও তালিম দিয়ে দিয়েছেন কমিশনের অফিসারেরা।