আম-আকালে হাপুস ধ্বনি বাঙালির পাতে

অন্ধ্রের গোলাপখাস, বেগমফুলি খেয়ে খেয়ে জিভে চড়া পড়ে গিয়েছে ডোমজুড়ের লিপিকা মুখোপাধ্যায়ের। ঘরোয়া হিমসাগরের আকালে নিউ মার্কেটে আলফান্সোর পেটির দিকে তাকিয়েই জিভে জল আসছে তাঁর! ভবানীপুরের বিমল বেদও আশায় বুক বাঁধছেন। চার বছরের নাতি (মেয়ের ছেলে) কণিষ্ক আলফান্সো চেখে ভারী খুশি হয়েছিল। দামটা এমন কমতির দিকে থাকলে জামাই-বাড়িতে আরও ঘন ঘন কয়েক পেটি পাঠানো যাবে বই কী!

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৪ ০১:৩৯
Share:

অন্ধ্রের গোলাপখাস, বেগমফুলি খেয়ে খেয়ে জিভে চড়া পড়ে গিয়েছে ডোমজুড়ের লিপিকা মুখোপাধ্যায়ের। ঘরোয়া হিমসাগরের আকালে নিউ মার্কেটে আলফান্সোর পেটির দিকে তাকিয়েই জিভে জল আসছে তাঁর!

Advertisement

ভবানীপুরের বিমল বেদও আশায় বুক বাঁধছেন। চার বছরের নাতি (মেয়ের ছেলে) কণিষ্ক আলফান্সো চেখে ভারী খুশি হয়েছিল। দামটা এমন কমতির দিকে থাকলে জামাই-বাড়িতে আরও ঘন ঘন কয়েক পেটি পাঠানো যাবে বই কী!

সাকিন, পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারত। খাস ঠিকানা মহারাষ্ট্রের রত্নগিরি। স্থানীয় বুলিতে ডাকনাম, হাপুস। দামের নিরিখে আমগেরস্তের অধরা আমটির আশায় এখন এই বাংলামুলুকেও অনেকের চোখ চকচক করছে। এক দিকে এই তল্লাটে স্থানীয় আমের আকাল, অন্য দিকে প্রধানত ইউরোপের বাজারের দিকে তাকিয়ে থাকা আলফান্সোর উপরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা এই জোড়া ধাক্কায় হঠাৎই আমবাঙালির কপালে শিকে ছিঁড়তে চলেছে।

Advertisement

বছর দুয়েক আগে স্বাস্থ্যহানিকর ‘এনজাইম’ আবিষ্কারের জেরে কপাল পুড়েছিল বাংলার বাগদা চিংড়ির। জাপান-আমেরিকার বাজারে তার রফতানি বাতিল হওয়ায় প্রায় অর্ধেক দামে চিংড়ি-ভোগের বরাত খুলে গিয়েছিল বাঙালির। এ বার এ দেশের উচ্ছে, বেগুন, মানকচু, চিচিঙ্গের সঙ্গে আলফান্সোতেও অবাঞ্ছিত মাছি ও সংক্রামক কীটের হদিস পেয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিশেষজ্ঞেরা। ফলে, আগামী দেড় বছরের জন্য ইউরোপে প্রবেশ নিষেধ আলফান্সোর। নিষেধাজ্ঞা তুলতে অবশ্য উদ্যোগী হয়েছে ব্রিটেন। ব্রিটিশ মন্ত্রী লর্ড ডে মাওলে বৈঠক করেছেন ব্রিটিশ ও ভারতীয় আম ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনায় সাহায্য করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তিনি। তবে এখনও পরিস্থিতি বদলায়নি।

এই নিষেধাজ্ঞার পটভূমিতে কলকাতাতেও অন্য বারের তুলনায় বেশি আলফান্সো আসতে শুরু করেছে বলে জানাচ্ছেন আম-ব্যবসায়ীরা।

কৃষিবিজ্ঞানীদের মতে, দেশি বাজারের বিভিন্ন ফল-সব্জির মতো আমেও থাকতে পারে বিপজ্জনক উপাদান। কীটনাশকের কল্যাণেও সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকছে। তবে বিশদে পরীক্ষার দস্তুর নেই।

বিপদের বহর নিয়ে তাপ-উত্তাপও নেই তেমন।

চাঁদনি চক এলাকার ফল-বাজারে বিলেতের নিষেধাজ্ঞাটাই বরং বিপণনের হাতিয়ার! এত সস্তায় আলফান্সো জিন্দগিতে মিলবে না বলেই বিক্রেতা মহম্মদ নাসিম, মহম্মদ কবীররা বাঙালিকে লোভ দেখাচ্ছেন। পেটি (এক ডজন আমের বাক্স) খুলে নিটোল সোনারঙা ফল বার করে বোঝাচ্ছেন, কী খোশবাই! লন্ডনে রফতানি বাতিল হয়েছে বলেই না এমন সহজে মিলছে! নইলে মুম্বই থেকে আমদানি করতে দু’দিন আগে অর্ডার দিতে হতো।

ধর্মতলা এলাকার বাসিন্দা সঞ্জয় সিংহের বউদি আবার মুম্বইয়ের মেয়ে! ৪০০ টাকা ডজনের ‘অফার’ শুনে একটু দোনামোনা করে শেষমেশ রাজিই হয়ে গেলেন বেসরকারি সংস্থার মাঝারি স্তরের কর্মচারী। তাঁর হাতে আমের বাক্সে বড়-বড় হরফে লেখা ‘উঁচি লোগোঁ কি উঁচি পসন্দ’!

রত্নগিরির আলফান্সোর দাম এই সময়ে ১০০০ বা ৮০০ টাকা ডজনে ঘোরা-ফেরা করে কলকাতায়। তা এক ধাক্কায় ৪০০ টাকায় নেমে এসেছে। বেঙ্গালুরু, কেরলের আলফান্সোও আসছে এখানে। মেছুয়ার (জোড়াসাঁকো) ফলবাজারের শঙ্কর ফলওয়ালা বলছেন, ২৫০-৩০০ টাকা ডজনের হাপুসও দিতে পারি।

এখনও হিমসাগর, গোলাপখাসদের (৫০-৬০ টাকা কেজি) চেয়ে ঢের চড়া দাম আলফান্সোর। কিন্তু নিউ মার্কেটের ফলব্যবসায়ী সন্দীপ চিনে বা ভবানীপুরের যদুবাবুর বাজারের মদনের দোকানের পোড়খাওয়া কর্মচারী সত্যব্রত জানারা বলছেন, গত তিন-চার বছরে আলফান্সোর এতটা কম দাম দেখা যায়নি। আগে মাসে হাজার পেটির দেখা মিললে এখন তিন হাজার পেটি মজুত হচ্ছে।

মুম্বইয়ের ক্রফোর্ড মার্কেটের মনীশ পার্সওয়ানির মতো ডাকসাইটে রফতানিকারীরা অবশ্য পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতে রফতানি করছেন। ভাসির এপিএমসি মার্কেটের আলফান্সো ব্যবসায়ী রাজকুমার সচদেব ওরফে রাজুভাই হিসেব কষলেন, মরসুমে অন্তত ১০টা বিমান বোঝাই-করা হাপুস ব্রিটেন, জার্মানি, সুইৎজারল্যান্ডে যায়। তার শতকরা ৬০ ভাগই দুবাই, মাস্কট, কুয়েতমুখী। দেশি বাজারে জোগানও ১০-১৫ শতাংশ বেড়েছে বলে দাবি রাজুভাইয়ের। ব্যবসায়ীদের দাবি, আলফান্সো কেনার পরে ১৫-২০ দিন রেখে দেওয়া যায়। আর এই আমে সুগারের মাত্রাও পরিমিত। আলফান্সোর ‘ইউএসপি’ হিসেবে এই দুই বিষয়কে তুলে ধরতে মরিয়া মুম্বইয়ের ব্যবসায়ীরা।

তবে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে আলফান্সোর বাজারকে তেমন আমল দিতে রাজি নন মেছুয়ার ফলবাজারের ব্যবসায়ী সংগঠনের কর্তা ইফতিকার আলম। তাঁর মতে, তা আমের মোট বাজারের পাঁচ শতাংশের বেশি নয়। এ তল্লাটে লোকে হিমসাগর-ল্যাংড়ারই ভক্ত! তবে সৌখিন আম, উপহার হিসেবে হাপুস বিশেষ পছন্দ কলকাত্তাইয়া রইসদের।

তাঁর সঙ্গে একমত, ভবানীপুরবাসী গিন্নি প্রেমলতা বনশল। বলছেন, বন্ধুবান্ধব বা কুটুমবাড়িতে পাঠাতে হলে আলফান্সোর জুড়ি নেই। দামেও চড়া, দেখতেও খুবসুরত--- এমন উপহার আর কী আছে! কিন্তু রূপে ভোলালেও আলফান্সোয় মাঝেমধ্যেই স্বাদে ঠকতে হয়। বিয়ে হওয়া ইস্তক কলকাতাবাসী বনশল-গিন্নি তাই স্বাদের নিরিখে ঘোর হিমসাগর-পন্থী।

কিন্তু বাংলার হিমসাগর এ বার সংখ্যালঘুর দলে। কলেজ স্ট্রিটের গ্রীষ্মকালীন আম বাজারের ব্যবসায়ী-সংগঠনের কোষাধ্যক্ষ রতন সাহা আফশোস করছিলেন, “অন্য বার কারবার চালাতে রাত কাবার হয়ে যায়। এখন রাত আটটা নাগাদ মার্কেটে ঢুকে বারোটা-সাড়ে বারোটায় বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।” মাসখানেক কী মাস দেড়েকের এই পাইকারি আমবাজারে প্রধান জোগানদার বসিরহাট। এর পরে কিছু দিন নদিয়ার শান্তিপুরের আমের পরে অল্প ক’দিনের জন্য মালদহের আমের দেখা মিলবে।

কলেজ স্ট্রিটের পাইকারি আম-ব্যবসায়ীদের মতে, বসিরহাটের গোবিন্দভোগ ও হিমসাগর এখন বাজারে থাকলেও তা অন্য বারের ২০ শতাংশের বেশি নয়। ল্যাংড়া খুঁজতে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে চোখ লাগাতে হবে। বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কৌশিক ব্রহ্মচারীর মতে, “অসহ্য গরম ও বৃষ্টির আকালে আমের দফা রফা হয়েছে। আমের এমন দুর্দশা বিরল।” মালদহের আম ব্যবসায়ী সংগঠনের অন্যতম কর্তা তথা কোতোয়ালি অঞ্চলের বাগান-মালিক উজ্জ্বল চৌধুরীও বলছিলেন, “মালদহে অন্য বারের ফলনের ৪০ শতাংশ আম হয়েছে এ বার।”

এই অবস্থায় বাঙালির আম-বিলাসের প্রধান ভরসা এখন, মাদ্রাজি আম বলে পরিচিত গোলাপখাস, বেগমফুলি (প্রধানত অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক থেকে আসা)-রা। আলফান্সোর জোগানও আরও মাসখানেক জারি থাকবে। তার দামটা কমতে থাকলে পছন্দের আমের অভাবে আমবাঙালিও কি তবে হাপুস বা আলফান্সো-অনুগামী হবেন?

বার্মিংহামের কাছে উল্ভারহ্যাম্পটনে কর্মরত কৃষ্ণঅর্চনা বসু ছুটিতে সদ্য শহরে ফিরেছেন। প্রবাসেই আলফান্সোর সঙ্গে আলাপ কলকাতা-কন্যার। নিষেধাজ্ঞার জেরে এ বার অবশ্য সেটা জোটেনি। বললেন, “বিলেতে আলফান্সো খেলেও কলকাতায় হিমসাগর-ল্যাংড়া ছাড়া অন্য কিছু মোটেও ভাবতে পারছি না।” এখনও পর্যন্ত যা হিমসাগর পেয়েছেন, তাতে মন ভরছে না আম্ররসিক তরুণীর। আর ল্যাংড়ার মরসুম পুরোপুরি জমতে আরও মাসখানেক।

মেছুয়ার ফল-মান্ডির হাওয়ায় যা খবর ভাসছে, তাতে উত্তরপ্রদেশে কিছু আম হলেও বিহারেও ল্যাংড়ার ফলন এ বার সুবিধের নয়। এই অবস্থায় গাঁটের কড়ি গচ্ছা দিয়ে জিভের রুচি ফেরাতে কেউ কেউ হাপুসের শরণাপন্ন। তবে সব মিলিয়ে বাঙালির আম-ভাগ্যের কাঁটা ঘোচার লক্ষণ নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন