আমাকে অভিনেতা হওয়ার প্রেরণা দিয়েছে বাগবাজার

আমার জন্ম উত্তর কলকাতার বাগবাজারে। এই বাগবাজারেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পেইরিং দুর্গ নির্মাণ করেছিল নবাবের অনুমতি ছাড়াই। সিরাজদ্দৌলা ভেঙে দিয়েছিলেন। এখনও সেই ঐতিহাসিক মরাঠা ডিচ লেন আছে স্বনামে। সরু হয়ে যাওয়া খালটার সামনে মরাঠাদের দৌরাত্ম্য আজ শুধুই স্মৃতি। এখনও সময় পেলে সেখানেই দু’ দণ্ড দাঁড়িয়ে সেই ইতিহাসকে খোঁজার চেষ্টা করি। আজ ওখানে হাট বসে। পাখি, কুকুর, গাছ মাছ বিক্রি হয়। এই প্রজন্ম হয়তো জানেই না এখানেই লুকিয়ে আছে কত স্মৃতি। আমি ধন্য এখানেই জন্মেছি বলে।

Advertisement

সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:৩১
Share:

‘হ্যামলেট’ নাটকে সুরজিৎ।

আমার জন্ম উত্তর কলকাতার বাগবাজারে। এই বাগবাজারেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পেইরিং দুর্গ নির্মাণ করেছিল নবাবের অনুমতি ছাড়াই। সিরাজদ্দৌলা ভেঙে দিয়েছিলেন। এখনও সেই ঐতিহাসিক মরাঠা ডিচ লেন আছে স্বনামে। সরু হয়ে যাওয়া খালটার সামনে মরাঠাদের দৌরাত্ম্য আজ শুধুই স্মৃতি। এখনও সময় পেলে সেখানেই দু’ দণ্ড দাঁড়িয়ে সেই ইতিহাসকে খোঁজার চেষ্টা করি। আজ ওখানে হাট বসে। পাখি, কুকুর, গাছ মাছ বিক্রি হয়। এই প্রজন্ম হয়তো জানেই না এখানেই লুকিয়ে আছে কত স্মৃতি। আমি ধন্য এখানেই জন্মেছি বলে। আমার ভ্যগ্যের যা উন্মোচন তা উত্তরের এই মাটি থেকেই। এখনও গিরিশচন্দ্রের পাড়া দিয়ে থিয়েটার করতে গেলে ওঁর বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত মূর্তিকে প্রণাম করেই যাই। অসাধারণ অনুভূতি। আবার এই পাড়াতেই বোসেদের বাড়ি। রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন শুরু করে গান বাঁধেন ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’। দুঃখ হয়, বাগবাজারে ১৬/এ বোসপাড়া লেন-এ ভগিনী নিবেদিতার বাড়িটি ভগ্নদশা দেখে। কিন্তু তার ঐতিহাসিক দিকটি আমরা ভুলতে পারব কি? এমন পাড়ায় আমাদের চার পুরুষের বাস। মামারা অভিনেতা। মেজ মামা বিজন মুখোপাধ্যায় নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ির ছাত্র ছিলেন। ছোট মামা ছিলেন যাত্রার কিংবদন্তি অভিনেতা স্বপনকুমার। সেই পরিবারেই আমার জন্ম। ছোট থেকেই আকাশবাণী কলকাতা থেকে সম্প্রচারিত নাটক শুনেছি। শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মলকুমার, বিকাশ রায়, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, কেয়া চক্রবর্তী, সন্তু মুখোপাধ্যায়, শ্যামল সেন। সেই সময় বাবা ও মায়ের হাত ধরে কখনও সখনও উত্তরা, শ্রী, মিনার বা রূপবাণীতে বাংলা সিনেমা দেখতে গেছি।

Advertisement

তবে এই চেনা এলাকা ছাড়িয়ে প্রথম রবীন্দ্রসদনে উৎপল দত্তের ‘জয়বাংলা’ যাত্রাপালা দেখতে গিয়েছিলাম। উফ, সে কি অনুভূতি। আমার মামা বিজন মুখোপাধ্যায়ও অভিনয় করেছিলেন। প্রেরণা পেয়েছিলাম তাঁর থেকেই প্রথম। তখন ’৭০-’৭১ সালটা বড় ভয়ঙ্কর ছিল। রোজ খুন, অহরহ বোমার শব্দ। ইচ্ছে থাকলেও অনেক ভাল ভাল অভিনয় দেখতে যেতে পারিনি। কারণ বাড়ির অনুমতি ছিল না। রাস্তাঘাটে বেরোনোও সমস্যা ছিল। তার আগে অবশ্য বড় মামার দৌলতে নিউ মার্কেট চিনেছি। পরে একটু একটু করে বাগবাজার, হাতিবাগান, নিউ মার্কেট, এন্টালি আমার জীবনে এক অদ্ভুত প্রভাব ফেলতে শুরু করল। ওখানেই গেলে মনে হত, সত্যি পৃথিবীটা কত বড়। কারণ ওখানে সি আই টি রোডে মামা স্বপনকুমার থাকতেন। পরবর্তীতে আমার অভিনেতা হওয়ার মূলে তিনি-ই যে বড় প্রেরণা। রবীন্দ্রসদনে যে দিন দেখেছি স্বপনকুমারকে বি এফ জে অ্যাওয়ার্ড দিচ্ছেন উত্তমকুমার ও রাজেশ খন্না, সে দিনই মনে হয়েছিল আমিও পারব অভিনয়ে নিজের দক্ষতা তুলে ধরতে। সেই থেকে ঘরে-বাইরে সর্বত্রই নাটকের রেওয়াজ বাড়িয়ে দিলাম। বাড়িতে সময় পেলেই নিজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিতে অভিনয় রপ্ত করতাম।

কলকাতার বাগবাজার ঘিরে আমার জীবনের ভাল-মন্দ সবটাই বলতে পারেন। প্রেম, স্কুলজীবন, পাড়ার নাটক এমনকী শিক্ষক হিসেবে কবি অমিতাভ দাশগুপ্তকে পাওয়া—সবই এই বাগবাজারে। রবীন্দ্রসদনে রাত জেগে লাইন দিয়ে শম্ভু মিত্রের নাটকের টিকিট কাটতে যে প্রেরণা দরকার তার পিছনেও এই পাড়ার অবদান এখনও স্বীকার করি। পাড়ায় তখন নাটক নিয়ে এত উত্তেজনা চলত যে রাত জেগে টিকিট পাওয়া লটারি পাওয়ার সমান। সেই সময়ে বিজ্ঞানের অধ্যাপক শিবনাথ চট্টোপাধ্যায় ও সংস্কৃতিমনস্ক গৌতম হালদার অনেক প্রেরণা দিয়েছেন। আজও তা ভুলিনি।

Advertisement

এই শহরের প্রতিটি প্রেক্ষাগৃহ আমার স্বপ্ন ও সাধনা। হাতিবাগানের সেই সব ঐতিহাসিক মঞ্চ রঙ্গমহল, বিশ্বরূপা, স্টার এরাই আমার জীবনের সব স্বপ্নকে বাস্তব করে তুলেছে। আজ যখন রবীন্দ্রসদনে অভিনয় করি, তখন মনে হয় এই মঞ্চেই শম্ভু মিত্রের অভিনয় দেখেছি। উৎপল দত্তের টিনের তলোয়ার হচ্ছে। দর্শক শম্ভু মিত্র— তাও দেখেছি। ওই একই মঞ্চে স্বপনকুমারের অভিনয় দেখতে এসেছিলেন উত্তমকুমার। আর এখন আমার অভিনয় দেখতে এসেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। আমি ওঁদের আশীর্বাদ না পেলে অভিনয় করতে পারতাম কি?


‘শ্রী শম্ভুমিত্র’ নাটকে সুরজিৎ।

মঞ্চ ছাড়িয়ে কখন যে চলে এসেছি ছোট পর্দায়, টালিগঞ্জের স্টুডিওতে, এখন ভাবতে কেমন অবাক লাগে। তবে এখনও সময় পেলে আড্ডা দিই। আগে চায়ের দোকানে আড্ডা দিতাম। কখনও গিরিশ মঞ্চে হরেনদার চায়ের দোকান, কখনও অ্যাকাডেমিতে সাজঘরের পিছন দিকের চায়ের দোকানে। এখন অত সময় পাই না। মাঝে মধ্যে চলে যাই ‘কাফে কফি ডে’ তে। আড্ডার বিষয় অবশ্যই শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্তরা।

এই শহরে আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি শম্ভু মিত্র হয়ে মঞ্চে অভিনয় করা। সেই কবেকার অধরা স্বপ্ন আর অধরা রইল না। প্রথম দিন তো আনন্দে কেঁদেই ফেলেছিলাম। মঞ্চ ছেড়ে যখন গ্রিনরুমে ঢুকছি, একজন আমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। তিনি নাকি আমার অভিনয়ে শম্ভু মিত্রের ছায়া দেখেছেন। এত বড় কথা শোনার স্পর্ধাও আমার নেই। কিন্তু কোথায় যেন মনে হল, এই শহর এখনও নাটকের ভাল বা মন্দ বড় সূক্ষ্ম ভাবে বিচার করেন। আমি পারি বা না পারি দর্শক কিন্তু তা ধরিয়ে দেন সময় মতো। এটাও বড় প্রাপ্তি।

লেখক: অভিনেতা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement