একই শিশুকে জন্মের দু’টি শংসাপত্র দিয়ে বিতর্কে পুর-কর্তৃপক্ষ

মা-বাবা একই। শিশুর নামেও কোনও বদল নেই। তবু সেই একই শিশুর নামে জন্মের দু’টি শংসাপত্র বার করে বিতর্কে জড়িয়েছে কলকাতা পুরসভা। দু’টি শংসাপত্রের মধ্যে তফাৎ দু’বছরের। প্রথমটি দেওয়া হয়েছিল ২০১২ সালে, ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশের ভিত্তিতে। পরে ওই শিশুকে দত্তক নেওয়া হয়েছে দেখিয়ে একই মা-বাবা ২০১৪ সালে পুরসভা থেকে আরও একটি শংসাপত্র বার করেন।

Advertisement

জয়তী রাহা

শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:৪০
Share:

মা-বাবা একই। শিশুর নামেও কোনও বদল নেই। তবু সেই একই শিশুর নামে জন্মের দু’টি শংসাপত্র বার করে বিতর্কে জড়িয়েছে কলকাতা পুরসভা। দু’টি শংসাপত্রের মধ্যে তফাৎ দু’বছরের। প্রথমটি দেওয়া হয়েছিল ২০১২ সালে, ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশের ভিত্তিতে। পরে ওই শিশুকে দত্তক নেওয়া হয়েছে দেখিয়ে একই মা-বাবা ২০১৪ সালে পুরসভা থেকে আরও একটি শংসাপত্র বার করেন।

Advertisement

প্রশ্ন উঠেছে, একটি শিশু ক’বার জন্মাবে? শিশুকে দত্তক নেওয়া বা না নেওয়ার সঙ্গে নতুন করে তার জন্মের শংসাপত্র দেওয়ার সম্পর্ক কী? শংসাপত্রে তো দত্তকের কোনও উল্লেখই থাকে না। পুরসভার মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) অতীন ঘোষ এ বিষয়ে যুক্তিগ্রাহ্য কোনও উত্তর দিতে পারেননি। তাঁর দাবি, “পুরসভার কাছে যদি কেউ জন্ম-নথি বার করার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের অর্ডার নিয়ে আসেন, তবে পুরসভা তা দিতে বাধ্য। আমরাও প্রথমে সেই মতোই শংসাপত্রটি দিয়েছিলাম। শিশুটি দত্তক সন্তান। ওর মা-বাবা নিয়ম জানতেন না। তাই জন্মস্থানের উল্লেখের ক্ষেত্রে ভুল তথ্য দিয়েছিলেন। তাই আগের শংসাপত্রটি বাতিল করে নতুন শংসাপত্র বার করা হয়।” তবে কলকাতার প্রাক্তন মেয়র বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বিষয়টির মধ্যে ঘোর অনিয়ম দেখতে পেয়েছেন। তাঁর কথায়, “পুরসভায় কী ধরনের তুঘলকি চলছে, এটা তারই প্রমাণ।”

একই কারণে অনিয়মের অভিযোগ তুলে পদত্যাগ করেছেন পুর-স্বাস্থ্য দফতরের সংশ্লিষ্ট ম্যানেজার দেবাশিস সেন। জন্মের শংসাপত্রের এই গরমিল নিয়ে সে ভাবে যুক্তি দেখাতে না পারলেও বিভাগীয় ম্যানেজারের পদত্যাগ নিয়ে মেয়র পারিষদের বক্তব্য, ৩১ ডিসেম্বর তো তাঁর কাজের মেয়াদ শেষ হয়ে যেত। অতএব এই পদত্যাগের কোনও অর্থই নেই।

Advertisement

জন্মের শংসাপত্র বার করার কিছু নিয়ম রয়েছে। সেই অনুযায়ী, কোনও শিশু যদি হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে জন্মায়, সে ক্ষেত্রে তার জন্মবৃত্তান্ত হাসপাতাল বা নার্সিংহোম থেকে পুরসভায় চলে যায়। সমস্যা হয় যদি শিশুটি বাড়িতে জন্মায়। সে ক্ষেত্রে এক বছরের মধ্যে হলে, যে ওয়ার্ডে জন্মাচ্ছে, সেখানকার মেডিক্যাল অফিসারের কাছে তার নাম নথিভুক্ত করাতে হয়। তবে এক বছর পেরিয়ে গেলে তা করা যায় না। তখন শংসাপত্র বার করাতে এফিডেভিট করিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে আসতে হয় শিশুটির বাবা-মাকে।

এ ক্ষেত্রে শিশুটির জন্মের তারিখ ২১ নভেম্বর, ২০১০। প্রথম বার জন্মের শংসাপত্র দেওয়ার তারিখ ১০ ডিসেম্বর, ২০১২। অতএব শিশুটির এক বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেই এই শংসাপত্র নেওয়া হয়। ধরে নেওয়া যায় পুরসভার নিয়ম মেনে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে অর্ডার এনেই এই শংসাপত্র দেওয়া হয়েছিল। এর ঠিক দু’বছরের মাথায় ২ ডিসেম্বর, ২০১৪ ফের একটি শংসাপত্র বার করা হয়। ওই একই শিশু ও একই মা-বাবার নামে। বদলে গিয়েছে শুধু জন্মস্থান। এর জন্য ওই একই দিনে প্রথম শংসাপত্রটিকে বাতিল করেছেন পুরসভার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক স্নেহাংশু চৌধুরী। কারণ দেখিয়েছেন, শিশুটি দত্তক। অথচ দত্তক সন্তানের ক্ষেত্রে পুরসভার দেওয়া জন্ম শংসাপত্রের কোথাও ‘দত্তক’ বিষয়টি উল্লেখ থাকে না। আরও প্রশ্ন উঠছে, ম্যাজিস্ট্রেটের অর্ডার কী ভাবে বাতিল করতে পারেন পুরসভার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক। স্নেহাংশুবাবু বলেন, “কোর্ট অর্ডারের ভিত্তিতেই বাতিল করা হয়।” কিন্তু দ্বিতীয় বার শংসাপত্র দেওয়ার সময়ে ‘নোট’ দিয়ে মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক স্নেহাংশুবাবু আদালতের কোনও নির্দেশের উল্লেখ করেননি। লিখেছেন, শিশুটিকে ‘দত্তক’ নেওয়া হয়েছিল। তাই পুরনো শংসাপত্র বাতিল করে নতুন দেওয়া হচ্ছে। এক আইনজীবী অসিতকুমার চৌধুরী তথ্যের অধিকার আইনে পুরসভার কাছে বিষয়টি জানতে চান। তাঁর দাবি, নতুন শংসাপত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও কোর্ট অর্ডার পুরসভা এখনও দেখাতে পারেনি।

অন্য দিকে, অতীনবাবু জানাচ্ছেন, পুরসভার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ম্যাজিস্ট্রেটের অর্ডার বাতিল করতেই পারেন। ১৯৬৯ সালের পুরসভার আইনেই সেই সংস্থান রয়েছে। অবশ্য বিষয়টি মানছেন না প্রাক্তন মেয়র বিকাশবাবুও। তাঁর বক্তব্য, “ম্যাজিস্ট্রেটের অর্ডার এ ভাবে বাতিল করা যায় না। এর পিছনে অন্য কোনও রহস্য লুকিয়ে থাকতে পারে।”

কলকাতা পুরসভায় কংগ্রেসের পরিষদীয় দলনেত্রী মালা রায়ের কথায়, “সংশ্লিষ্ট দফতর এবং ওই দফতরের মেয়র পারিষদই বলতে পারবেন কোন নিয়মে এই কাজ হয়েছে। বিষয়টি না জেনে এর বেশি বলা সম্ভব নয়।” পুরসভায় বিজেপির মুখ্য সচেতক সুনীতা ঝাওয়ার বলেন, “জন্মের শংসাপত্র দেওয়া নিয়ে এটি চূড়ান্ত অরাজকতার দৃষ্টান্ত। এই সংক্রান্ত ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত রয়েছে। বারংবার বলা সত্ত্বেও কোনও কাজ হচ্ছে না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন