কলকাতা ফিরুক কলকাতাতেই

মায়ের পেট থেকে বেরোলাম। কে যেন কানে কানে বলল, তোর ভাল লাগা, ভালবাসার শহর কলকাতায় তোকে দিয়ে গেলাম। চোখ ফোটেনি। ফোটবার কথাও নয়! কিন্তু কল্পনায় মিষ্টি এক সুবাসে ভরে গেল ছোট্ট শিশুর মন, প্রাণ। যত দিন মাতৃজঠরে ছিলাম, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছি, আমায় কলকাতায় জন্ম দিও। ঈশ্বর কথা শুনেছিলেন। বড় হতে লাগলাম। কাকা, জ্যাঠা, পিসি, খুড়তুতো-জ্যাঠতুতো ভাই বোন, ঠাকুমা-ঠাকুর্দা— সবাইকে নিয়েই চাটুজ্জে পরিবার। স্কুলে ভর্তি হলাম, বাড়ি থেকে সামান্য দূরে। কাজের লোকের সঙ্গে হেঁটেই যাতায়াত করতাম। পরিষ্কার রাস্তাঘাট, গাড়িঘোড়া কম। লোকজনও কম। চিৎকার হল্লাও কম। মানুষের মধ্যে ঝগড়াঝাটি নেই। একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল।

Advertisement

বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ মে ২০১৪ ০০:০৫
Share:

শ্যামনগরের রবীন্দ্র ভবনে ‘আবাসন প্রকল্প’ নাটক।

মায়ের পেট থেকে বেরোলাম। কে যেন কানে কানে বলল, তোর ভাল লাগা, ভালবাসার শহর কলকাতায় তোকে দিয়ে গেলাম। চোখ ফোটেনি। ফোটবার কথাও নয়! কিন্তু কল্পনায় মিষ্টি এক সুবাসে ভরে গেল ছোট্ট শিশুর মন, প্রাণ। যত দিন মাতৃজঠরে ছিলাম, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছি, আমায় কলকাতায় জন্ম দিও। ঈশ্বর কথা শুনেছিলেন। বড় হতে লাগলাম। কাকা, জ্যাঠা, পিসি, খুড়তুতো-জ্যাঠতুতো ভাই বোন, ঠাকুমা-ঠাকুর্দা— সবাইকে নিয়েই চাটুজ্জে পরিবার। স্কুলে ভর্তি হলাম, বাড়ি থেকে সামান্য দূরে। কাজের লোকের সঙ্গে হেঁটেই যাতায়াত করতাম। পরিষ্কার রাস্তাঘাট, গাড়িঘোড়া কম। লোকজনও কম। চিৎকার হল্লাও কম। মানুষের মধ্যে ঝগড়াঝাটি নেই। একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল। সদা হাস্যময় আমার সে দিনের কলকাতা।

Advertisement

দিন যায়, দ্রুত বদলায় সেই কলকাতা। জনসংখ্যা বাড়তে থাকে,দলাদলি বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে গাড়িঘোড়া, ট্রাম ও বাস। মানুষ যেন মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারাতে থাকে। সহানুভূতিশীল মানুষগুলো কেমন যেন স্বার্থপর হতে থাকে। সব কিছু নিজের জন্য পেতে আগ্রহী হয়ে উঠতে থাকে। বুঝতে পারি, আমার কলকাতায় রাজনীতির রং লাগছে। আর সে রং বোধহয় সুস্থ রাজনীতির নয়। দেশ স্বাধীন হয়ে গিয়েছে কিন্তু সত্যিই কি আমরা স্বাধীন হলাম? ব্রিটিশরা পরাধীন করে রেখেছিল। আর এখন আমরা এক জন অন্য জনকে পরাধীন করে রাখার জন্য উঠে পড়ে লাগলাম। বাড়তে লাগল হানাহানি, কাটাকাটি, দাঙ্গা, মারপিট। কলকাতা রং বদলাতে লাগল। পরিবেশও বদলাতে লাগল। যে কলকাতায় প্রশ্বাস নিতে পারতাম অবলীলায়, কষ্ট হতে লাগল শ্বাস নিতে। অসুখে ভুগতে শুরু করল শহরবাসী। সবুজ মুছে যেতে লাগল। ইট, কাঠ, লোহা বোঝাই হতে লাগল। পাল্লা দেওয়া শুরু হল, কে কার থেকে বড় হবে। অসুস্থ প্রতিযোগিতায় ভরে যেতে লাগল আমার ভাল লাগার, ভালবাসার শহর। আর সেই অসুস্থতার মধ্যে তলিয়ে যেতে লাগল আমার কলকাতা। গোলাপের বাগান কারা যেন উপড়ে দিয়ে জলবিছুটির চারা ভরে দিতে লাগল কলকাতার বুকের উপর।

আগে যেমন আকাশ দেখা যেত, এখন যেন সেই আকাশ গগনচুম্বী ইমারতের আড়ালে হারিয়ে যেতে বসেছে। উঁচু বাড়ির ফাঁক দিয়ে যেটুকু দেখা। গরিব মানুষ আরও গরিব, বড়লোক আরও বড়লোক হল। শুরু হল দলাদলি। যারা দেশের, রাজ্যের ভাল করার জন্য বদ্ধপরিকর, তাদের মূল্যবোধ কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেল। মিথ্যে প্রতিশ্রুতির জাল বুনতে লাগল সবাই।

Advertisement


‘নান্দীকার’ নাটকের মহড়ায়।

কলকাতার প্রতি প্রেম আছে আজও, এখনও। কিন্তু চার পাশে তাকালে দেখতে পাই দিগভ্রান্ত মানুষগুলো হাঁটা ভুলে কেবলই ছুটছে। কেন ছুটছে, ছুটে কোথায় গিয়ে পৌঁছবে জানা নেই।

ছোটবেলা থেকে নাটক করতাম। হাতিবাগান ছিল নাটকের দেবালয়। কিন্তু সে নাটকপাড়া কোথায় যেন হারিয়ে গেল। খুব ব্যথা পাই। বুকের ভেতরটা গুমরে ওঠে। তখন নাটকপাড়ায় বা স্টুডিওপাড়ায় বাসেই যাতায়াত করতাম। নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছেও যেতাম। কিন্তু আজ সে সব দিন শুধুই কল্পনা। বহুরূপীতে যখন ছিলাম, তখন থিয়েটারের প্রতি একটা দায়বদ্ধতা ছিল, ছিল একটা মূল্যবোধ। সেও আজ আর নেই। বাড়তে বাড়তে নাটকের দলের সংখ্যা কত যে হয়েছে তা কেউই বলতে পারবে না। একই অভিনেতা বা অভিনেত্রী কতগুলো দলে অভিনয় করছে সেটা বোধহয় তাঁরা নিজেরাই জানেন না। কিন্তু এও কি সম্ভব?

আগে যে সব রাস্তায় অম্লান বদনে হাঁটা যেত আজ যেন সে সব অলীক কল্পনা। সমস্ত ফুটপাথ দখল হয়ে গিয়েছে। হাঁটাচলা দায়। এক রাজনৈতিক দল যদি ফুটপাথ খালি করতে যায়, অন্য দল এসে তাদের বসিয়ে দেয়। কিছু বলার নেই। এখানে আইন ভাঙা যেন কৃতিত্বের কাজ। আর এক নতুন বাহন এসেছে অটোরিকশা। তাদের দৌরাত্মে প্রাণ জেরবার হওয়ার জোগাড়। তার উপর যখন তখন শহরে মিছিল-মিটিং-অবরোধ। আমার একটাই প্রশ্ন, অবরোধ করে আজ পর্যন্ত কোনও কিছুর সুরাহা হয়েছে কি? অনেক ক্ষেত্রেই তা শুধু পেশিশক্তির আস্ফালন।

আসল জঞ্জাল কিন্তু আমাদের মনে। কোনও কিছু নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে আমরা ভুলে গিয়েছি। আমার চিন্তা হয় পরবর্তী প্রজন্মের কথা ভেবে।

আমার বাবা, মা এক সুন্দর শহরে এনেছিলেন আমাকে, সেটি আমার কলকাতা। সেই কলকাতাকে জীবন্ত রাখার দায়িত্ব আমাদের সকলের। কিন্তু আমরা এখন কোথায়? আগে এই শহরের সৌন্দর্য আমাদের মুগ্ধ করত, কোথায় গেল সেই মুগ্ধতা! যে শহরের বুকে ছিল এক সময়ের স্নিগ্ধতা, মনোরম পরিবেশ, আজ কেথায় যেন হারিয়ে গেল। আচ্ছা আমরা কি পারি না এই শহরকে আগের সুস্থতায় ফিরিয়ে আনতে? যদি না পারি তা হলে কীসের গর্ব আমাদের মানুষ হিসেবে? কলকাতা ফিরুক কলকাতাতেই।

—ফাইল চিত্র।

লেখক: অভিনেতা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন