বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসন বা স্বাধিকারে সরকারি হস্তক্ষেপ নিয়ে বিতর্ক আছেই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসারদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে যে শিক্ষা দফতরের অনুমোদন আবশ্যিক, সেই বিষয়ে কোনও মতবিরোধ নেই। তা সত্ত্বেও সরকারি নির্দেশনামার তোয়াক্কা না-করে অফিসারদের প্রোমোশন দিতে গিয়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। শেষ মুহূর্তে উচ্চশিক্ষা দফতরের হস্তক্ষেপে পদোন্নতির সিদ্ধান্ত গিলতে বাধ্য হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ।
বিকাশ ভবন সূত্রের খবর, পদোন্নতির জন্য ফলাও করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিল বিশ্ববিদ্যালয়। খবর পেয়ে উচ্চশিক্ষা দফতর নড়েচড়ে বসে। গোটা প্রক্রিয়াই যে বেআইনি, সেটা স্পষ্ট করে দিয়ে অবিলম্বে তা বন্ধ করার নির্দেশ দেয় তারা। পদোন্নতির পথে অনেকটা এগিয়ে গিয়েও তড়িঘড়ি সমস্ত প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় যাদবপুর। শিক্ষা শিবিরের প্রশ্ন, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসারদের পদোন্নতির ব্যাপারে নির্দিষ্ট সরকারি নির্দেশনামা থাকা সত্ত্বেও তা না-মেনে যাদবপুর-কর্তৃপক্ষ নিজেদের মতো করে কাজটা করতে গিয়েছিলেন কেন?
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, ২০০৬ সালের পর থেকে সেখানকার অফিসারদের পদোন্নতি হয়নি। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় স্বশাসিত সংস্থা হলেও অফিসারদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে সরকারি অনুমতি ও নির্দেশ দরকার। রাজ্যের কোষাগার থেকে ওই অফিসারদের বেতন হয়। তাই অফিসারদের পদোন্নতির বিষয়টি বিবেচনা করার সময় সরকারি কোষাগারের কথা মাথা রাখতে হয়। ২০০৬ সালের পরে শিক্ষা দফতরের তরফে যাদবপুরে পদোন্নতির বিষয়টি বিবেচনা করা হয়নি। সেই জন্য ঘুরপথে প্রোমোশন সেরে ফেলতে চেয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ। আর তাতেই নিয়ম লঙ্ঘনের দায় এসে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘাড়ে। উচ্চশিক্ষা দফতর স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, তাদের অনুমতি ছাড়া কোনও
ভাবেই কারও পদোন্নতি সম্ভব নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠনপাঠন বাদ দিলে যাবতীয় প্রশাসনিক কাজ করে ওই অফিসার মহলই। যাদবপুর ২০০৬ সালের পর থেকে পদোন্নতি না-হওয়ায় অফিসারদের মনে ক্ষোভ জমছিল। সেই ক্ষোভের আঁচ লাগছিল কর্তৃপক্ষের গায়েই। পদোন্নতির প্রয়োজন বুঝেও সরকারি নির্দেশনামা না-থাকায় কর্তৃপক্ষ সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। ক্ষোভ বাড়তে থাকায় তাঁরা মরিয়া হয়েই ঘুরপথে পদোন্নতির ব্যবস্থা করে তাঁরা এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছিলেন বলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরের খবর।
কী রকম?
বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসমিতির এক সদস্য বলেন, ‘‘ফেব্রুয়ারিতে কর্মসমিতির বৈঠকেই ঠিক হয়, প্রোমোশনের জন্য অফিসারদের এ বার আবেদন করতে বলা হবে।’’ তার পরেই সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। দেওয়া হয় বিজ্ঞপ্তিও। ইন্টারভিউ বোর্ড গড়ার কাজও প্রায় শেষ করে ফেলা হয়। এর ফলে সরকারের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতেও যেতে হল না কর্তৃপক্ষকে। আবার অফিসারদের বিরাগভাজন হওয়া থেকেও রেহাই পেলেন তাঁরা। এক ঢিলে এ ভাবেই দুই পাখি মারার বন্দোবস্ত হয়েছিল।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারীদের একাংশের বক্তব্য, পরিস্থিতি যেমনই হোক, কখনওই বেআইনি কিছু করা উচিত নয়। এক শিক্ষক বলেন, ‘‘পদোন্নতি প্রয়োজন, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু যে-প্রোমোশনের জন্য সরকারি নির্দেশিকা ও অনুমতির প্রয়োজন, সেখানে সরকারকে অন্ধকারে রেখে ওই কাজে এগোনো উচিত হয়নি।’’ অশিক্ষক কর্মচারীদের একাংশ মনে করছেন, এর ফলে সকলের কাছেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি খারাপ হল। ‘‘এটা ঠিক হয়নি,’’ বললেন এক অশিক্ষক কর্মী।
বেআইনি কাজ করা হচ্ছিল কেন?
বারবার চেষ্টা করেও উপাচার্য সুরঞ্জন দাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে তিনি দিল্লিতে রয়েছেন বলে খবর। প্রশ্ন উঠছে, পদোন্নতির ভবিষ্যৎ কী হবে?
উচ্চশিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, আর যা-ই হোক, আপাতত কোনও ভাবেই পদোন্নতির অনুমতি দেওয়া হবে না। কারণ রাজ্যের কোষাগারের যা অবস্থা, তাতে পদোন্নতির বিষয়টি নিয়ে এখন ভাবনাচিন্তা করতে চাইছে না সরকার। এখন সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর উপরেই জোর দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে সরকারের তরফে পদোন্নতি বকেয়া পড়ে যাওয়ার দায় চাপানো হচ্ছে পূর্বতন বাম সরকারের উপরেই। শিক্ষা দফতরের বক্তব্য, ২০০৬ সালের পরেও পদোন্নতির সমস্যা মেটানোর জন্য ২০১১ পর্যন্ত হাতে পাঁচ বছর সময় পেয়েছিল বামফ্রন্ট। কিন্তু তখন তারা বিষয়টি আদৌ ভাবনাচিন্তা করেনি। ঋণের বোঝার সঙ্গেই নানান সমস্যার দায় চাপিয়ে গিয়েছে পরবর্তী সরকারের ঘাড়ে।
পদোন্নতির বিষয়টি আপাতত বিবেচনার বাইরে রাখার সরকারি মনোভাবে যাদবপুরের অফিসারেরা স্বভাবতই অখুশি। তাঁদের একটা বড় অংশের অনুযোগ, খেলা-মেলায় সরকার যথেচ্ছ টাকা খরচ করতে পারছে। অথচ অফিসারদের দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা পদোন্নতির ব্যাপারে সরকারের কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। তাঁদের মন্তব্য, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কাজ করেও প্রোমোশন না-পাওয়াটা ক্ষোভের। এবং হতাশাজনকও।’’
অফিসারদের ক্ষোভের ব্যাপারে সরকার বিলক্ষণ ওয়াকিবহাল। শিক্ষা দফতরের একটি সূত্র জানাচ্ছে, এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা চলছে।