জেলার নাট্যচর্চা নাকি ‘কলকাতার কলতলা’

যদিও আমার জন্ম শহর কলকাতায়, কিন্তু ঘটনাচক্রে সপরিবারে আমরা উত্তর চব্বিশ পরগনার গোবরডাঙায় চলে আসি ১৯৭৩-এ। এখানেই নাটকের পোকা আমার মাথায় চেপে বসে। স্বাধীনতা-উত্তর গণনাট্য থেকে শুরু করে বাংলায় যে আধুনিক নাট্য-চর্চার জয়যাত্রা, তার তেমন কোনও পরম্পরা গোবরডাঙায় তখন অন্তত ছিল না। ১৯৮০-তে কয়েক জন বন্ধু মিলে এখানে আমরা ‘শিল্পায়ন’ নাট্য দল গঠন করি। ভাল থিয়েটারের যা কিছু ঐতিহ্য এবং চর্চার পটভূমি সবই শহর কলকাতাকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল।

Advertisement

আশিস চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০১৫ ০০:০০
Share:

যদিও আমার জন্ম শহর কলকাতায়, কিন্তু ঘটনাচক্রে সপরিবারে আমরা উত্তর চব্বিশ পরগনার গোবরডাঙায় চলে আসি ১৯৭৩-এ। এখানেই নাটকের পোকা আমার মাথায় চেপে বসে। স্বাধীনতা-উত্তর গণনাট্য থেকে শুরু করে বাংলায় যে আধুনিক নাট্য-চর্চার জয়যাত্রা, তার তেমন কোনও পরম্পরা গোবরডাঙায় তখন অন্তত ছিল না। ১৯৮০-তে কয়েক জন বন্ধু মিলে এখানে আমরা ‘শিল্পায়ন’ নাট্য দল গঠন করি। ভাল থিয়েটারের যা কিছু ঐতিহ্য এবং চর্চার পটভূমি সবই শহর কলকাতাকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল। আর শহুরে মানসিকতায় জেলার নাট্যচর্চাকে বলা হত কলকাতার কলতলা। আমাদের ওখানে তখন না ছিল টেলিফোন, না ছিল সড়ক পরিবহণ, উন্নত বিদ্যুৎ ব্যবস্থাও ছিল না। শিয়ালদহ থেকে ট্রামে চেপে আমরা শহরের নাট্যমঞ্চে যেতাম ভাল নাটক দেখতে। গভীর রাতে ট্রেনে করে বাড়ি ফিরে ভাবতাম আমরা কি কখনও পারব আমাদের গ্রাম বা জেলার নাট্যচর্চাকে ওই উচ্চতায় পৌঁছে দিতে?

Advertisement


আশিস পরিচালিত ‘আদিম’ নাটকের একটি দৃশ্যে দীপা ব্রহ্ম এবং শৌভিক সরকার।

১৯৯৬-তে অনেক টাকাপয়সা ধার করে একটা নাটক করেছিলাম ‘সম্প্রীতি বিলাস’ নামে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পটভূমিকায় এই নাটক তখন অনেক নাম করলেও উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবে দু’টি শো করেই নাটকটা ‘গোডাউন’-এ চলে যায়। আমি ভেঙে পড়লেও আমার সঙ্গীরা কেউ ভেঙে পড়েনি। তাদের মধ্যে অভীক বন্দ্যোপাধ্যায়, শৌভিক সরকার, প্রিয়েন্দুশেখর দাস এবং বর্তমানে আমার স্ত্রী অভিনেত্রী দীপা ব্রহ্ম মিলে ঠিক করল থিয়েটারে টাকা পয়সার প্রয়োজনে হস্তশিল্পের ব্যবসা করবে। আমাকেও সঙ্গে নেওয়া হল। আমি কিন্তু তখনই বুঝতে পেরেছিলাম এমন একটা থিয়েটার আমাকে তৈরি করতে হবে যার পরিবহনের খরচ প্রায় থাকবে না, ভ্রাম্যমাণ করা যাবে। কিন্তু, প্রযোজনাটির দম থাকবে প্রচুর। তারই ফলশ্রুতি আমার লেখা ও নির্দেশনায় ‘মালাডাক’। জেলার মঞ্চগুলিতে তখন ‘মালাডাক’ হইচই বাঁধিয়ে ফেলেছিল। ১৯৯৮-তে সেই নাটককে বাঁচিয়ে রাখতে জেলায় জেলায় আমরা হস্তশিল্পের দোকান দিতে শুরু করলাম। মনে আছে কলকাতার গিরিশমঞ্চে মালাডাক-এর প্রথম শো-এর টাকা এসেছিল আমাদের হস্তশিল্পের দোকান থেকে।

Advertisement


উপরে বাঁ দিকে ওম পুরী, ডান দিকে গৌতম হালদার,
নীচে বাঁ দিকে বিভাস চক্রবর্তী এবং ডান দিকে সুবোধ পট্টনায়কের সঙ্গে আশিস।

কাঁচা বয়সের আবেগে তখন ভাবছি কলকাতার নাট্য ঐতিহ্যে বুঝি ঢুকে পড়লাম। অচিরেই স্বপ্ন ভঙ্গ হল। অ্যাকাডেমির সামনে তখন একটা গাছ ছিল। কাপড়ের উপর লেখা মালাডাক-এর একটা ব্যানার সেখানে ঝুলিয়েছিলাম। দু’দিনের মধ্যেই কে বা কারা সেটা ছিঁড়ে ফেলে দিল। কেউ কেউ বললেন, জেলার লোক জেলায় বসে থিয়েটার করো, কলকাতায় কেন! দমিনি আমরা। ইতিমধ্যে মালাডাক-এর ১ হাজার ৩০ রজনী অভিনীত হয়েছে। এ কথা ঠিকই, ৩৫ বছর নাট্যচর্চা করে শিল্পায়ন এখন শুধুমাত্র গোবরডাঙার দল নয়। শহর কলকাতা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রদেশে বেশ কিছু ভাল নাটক তারা হাজির করতে পেরেছে। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ-এর নাটক আমরাই প্রথম এই বঙ্গে মঞ্চস্থ করি। ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’ নাটকের জন্য আমাকে দু’হাজার সালে শ্রেষ্ঠ নির্দেশক হিসেবে নাট্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয়। কমলকুমার মজুমদারের লেখা থেকে নেওয়া ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ বাংলা জুড়ে আলোড়ন তোলে। ভীষ্ম সহানির ‘তমস’ নাটকেও তাই হয়েছিল।


ব্রাত্য বসু এবং আশিস

২০০৯-এ মার্কস ও গাঁধীজিকে অবলম্বন করে প্রযোজনা করেছিলাম ‘খোয়াব’। দিল্লি, মুম্বই, অসম ও হরিয়ানায় ব্যাপক সাফল্য পায়। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আদিম’ বা লালন ফকিরের দর্শন নিয়ে ‘পড়শি’ এখনও প্রতি মাসে মঞ্চস্থ করতে হয় দর্শকদের অনুরোধে।

শহর কলকাতা আমাদের দিয়েছেও অনেক। এই শহরেই প্রকৃত থিয়েটারের বন্ধু পেয়েছি অনেক। যাদের মধ্যে অবশ্যই বলতে হবে ব্রাত্য বসুর কথা। শহরের নাট্যচর্চায় তিনি আমাদের অনেক জায়গা করে দিয়েছেন। তাঁর কাছে তাই ঋণ অনেক।


রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের সঙ্গে আশিস।

সত্যি কথা বলতে কী মফস্‌সলে থাকলেও নানা স্বপ্ন তাড়া করে বেড়ায় আমাদের। স্বপ্ন আছে নিজেদের জেলায় থিয়েটারের একটি স্থায়ী এবং শক্ত পরিকাঠামো গড়ে তোলা। কিন্তু সবার আগে প্রয়োজন শহর ও জেলার নাট্যচর্চার আপাত অদৃশ্য এই বিভাজনকে ভেঙে ফেলার। শুধু ভাল থিয়েটারই পারে এই সব বিভাজন মুছে ফেলতে।

লেখক: অভিনেতা ও নাট্য পরিচালক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন