হকারদের দখলে শহরের দুই ফুটপাথ। গড়িয়াহাট। সোমবার।
লোকসভা নির্বাচনের পারদ চড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভিড় বাড়ছে গড়িয়াহাট মোড়ে। এই ভিড় বাড়ার সঙ্গে অবশ্য ভোটের কোনও সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক চৈত্র সেলের। নববর্ষ যতই এগিয়ে আসছে, গড়িয়াহাটের ফুটপাথের সেই চেনা দৃশ্য ততই ফিরে আসছে। ফুটপাথ ক্রমেই চলে যাচ্ছে হকারদের দখলে।
গড়িয়াহাটের ফুটপাথ ছেড়ে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বছর চল্লিশের মহিলা মনীষা পাল বলেন, “অন্য সময়ে তা-ও দুপুরের দিকে ফুটপাথ ধরে হাঁটা যায়, কিন্তু পুজোর আগে বা চৈত্র সেলের সময়ে তো কোনও সুযোগই নেই। ভিড় ঠেলে দু’পা হাঁটতেই প্রাণ বেরিয়ে যায়।”
শুধু গড়িয়াহাট নয়, রাসবিহারী থেকে হাতিবাগান, শ্যামবাজার বা চৌরঙ্গি সর্বত্রই হকারদের দখলে ফুটপাথ। চৈত্র সেলের সময়ে এ সব জায়গায় হাঁটা কার্যত অসম্ভব। শুধু চৈত্র সেলই নয়, পুজো থেকে শুরু করে ধনতেরাস, ঈদ কিংবা রাখী উৎসব এলেই শহরের ফুটপাথ ঢেকে যায় হকারের পসরার জঙ্গলে। যেখানে পথচারীদের কার্যত ‘নো এন্ট্রি’।
ফুটপাথের উপরেই গজিয়ে উঠেছে সারি সারি দোকান। কোথাও কোথাও কাঠের পাটাতন পাতা। তার চার দিকে বাঁশ দিয়ে লাগানো হয়েছে প্লাস্টিকের ছাউনি। দু’টি রাস্তার সংযোগস্থল থেকে পঞ্চাশ ফুটও ছাড় নেই। এই দৃশ্য গড়িয়াহাট মোড়ের। রাসবিহারী অ্যাভিনিউ ও গড়িয়াহাটের সংযোগস্থলেও ফুটপাথের একই হাল।
উত্তর কলকাতার হাতিবাগান মোড় থেকে বিধান সরণি ধরে শ্যামবাজারের দিকে এগোলে চোখে পড়বে একই দৃশ্য। কোথাও কোথাও ফুটপাথের দু’দিকেই বসেছেন হকারেরা। মধ্যে সরু ফালি জায়গা যেন দয়া করে ছাড়া আছে পথচারীদের জন্য। দোকানগুলি ঘিরে সার দিয়ে প্লাস্টিক। সূর্যের আলো কার্যত ঢোকেই না ওই সমস্ত এলাকায়।
ব্রেবোর্ন রোডের দৃশ্যও একই রকম। তার সঙ্গে এখানে নতুন সংযোজন ফুটপাথের ধার ঘেঁষে হকারদের স্থায়ী নির্মাণ। ফুটপাথে কোনও জায়গাই আর ছাড়া নেই পথচারীদের জন্য। গত মাসেই ভারতীয় জাদুঘরের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আসবেন বলে চৌরঙ্গি এলাকা থেকে সব হকারকে তুলে দেওয়া হয়েছিল। নিত্যযাত্রীরা আশায় ছিলেন, এত দিনে চৌরঙ্গি রোডের ফুটপাথ দিয়ে বোধহয় যাতায়াত করা যাবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি। প্রধানমন্ত্রী ফিরে যেতেই চৌরঙ্গির দু’পাশের ফুটপাথ পুরনো অবস্থায় ফিরে গিয়েছে।
কিন্তু গড়িয়াহাটের হকার দেবনারায়ণ রায়ের দাবি, “পথচারীদের যাতায়াতে যাতে অসুবিধা না হয়, তা মাথায় রেখেই আমরা বসি। তবে বৃষ্টি বা রোদ থেকে মালপত্র বাঁচাতে প্লাস্টিক বা ত্রিপল লাগাতে হয়। সরকার যদি কোনও ব্যবস্থা করে, তা হলে আমাদের অসুবিধা নেই।” হাতিবাগানের হকার গৌতম দাস বলেন, “পথচারীদের অসুবিধে তো হয়ই। কিন্তু বিকল্প কোনও ব্যবস্থা নেই। ফলে ফুটপাথেই বসতে হচ্ছে।”
হকারদের দখলে শহরের ফুটপাথ।হাতিবাগান। সোমবার।
হকার সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক শক্তিমান ঘোষ বলেন, “কলকাতা পুরসভার তরফে হকার-নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কোনও উদ্যোগ নেই। পরিদর্শনও নেই। ফলে নিয়মনীতি না-মেনেই হকারেরা বিভিন্ন জায়গায় বসছেন।” শক্তিমানবাবুর অভিযোগ, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, টাউন ভেন্ডিং কমিটির মাধ্যমে হকারদের স্বীকৃতি দিয়ে শহরের নির্দিষ্ট জায়গায় বসার ব্যবস্থা করার কথা। গত সেপ্টেম্বর থেকে চার মাসের মধ্যে এই নির্দেশ পালন করার কথা ছিল। এখনও তা হয়নি। হকারদের জন্য কেন্দ্রীয় আইন মানা হয়নি বলেও শক্তিমানবাবুর অভিযোগ।
বর্তমান মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় কলকাতা শহরের হকার নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে কলকাতা পুরসভার প্রাক্তন মেয়র বিকাশ ভট্টাচার্য বলেন, “হকার নিয়ন্ত্রণে আমরা বেশ কিছু পদক্ষেপ করেছিলাম। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল, হকারেরাও যাতে থাকতে পারেন এবং পথচারীদেরও কোনও অসুবিধায় না পড়তে হয়। এখন সে সব কিছুই মানা হচ্ছে না।”
কলকাতা পুরসভা সূত্রের খবর, বিকাশবাবু মেয়র থাকার সময়ে শহরে হকার নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু পদক্ষেপ করা হয়েছিল। পুরসভার আধিকারিক, কলকাতা পুলিশ, হকার ইউনিয়নের প্রতিনিধি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে ‘অ্যাপেক্স’ কমিটি তৈরি হয়। এই কমিটি হকার-নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু নিয়ম চালু করে। সে সময়ে পুরসভা ঘোষণা করেছিল, হকারেরা সমস্ত নিয়ম মানছেন কি না, তা-ও নিয়মিত পরিদর্শন করা হবে। কিন্তু পদক্ষেপ করলেও ভোটব্যাঙ্কের কথা ভেবে এ ব্যাপারে তেমন কড়াকড়ি করেনি তদানীন্তন পুরবোর্ড।
রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ক্ষমতায় আসার পরে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশিকা মেনে সার্বিক হকার-নীতি তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পথচারী এবং হকার দুই তরফের অধিকার রক্ষা হবে, এমন ‘হকার নীতি’ই তৈরির ভাবনা সরকারের। কিন্তু এখানেও শাসকদলের আশঙ্কা হকারদের ভোট হারানোর। সে কারণেই সরকার ক্ষমতায় আসার তিন বছর পেরিয়ে গেলেও ওই নীতি চূড়ান্ত করতে পারেনি রাজ্য প্রশাসন। তৃণমূল কংগ্রেসের এক প্রবীণ নেতার কথায়, “হকার আন্দোলনের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম থেকেই জড়িত ছিলেন। তাই হকার নিয়ে চটজলদি কোনও সিদ্ধান্ত তিনি নিতে চান না।”
নিয়ন্ত্রণে করণীয়
• শহরে রাস্তার উপরে কোথাও হকারেরা বসতে পারবেন না।
• হকারেরা স্থায়ী নির্মাণ করতে পারবেন না।
• রাস্তার মোড় থেকে পঞ্চাশ ফুট ছেড়ে হকারদের বসতে হবে।
• ফুটপাথের তিন ভাগের এক ভাগে হকারেরা বসতে পারবেন। বাকিটা পথচারীদের জন্য ছাড়তে হবে।
• প্লাস্টিক বা ত্রিপল ব্যবহার করা যাবে না, যাতে আকাশ ঢাকা পড়ে যায়।
• ধর্মতলা থেকে চৌরঙ্গি পর্যন্ত ‘হেরিটেজ জোন’। সেখানে হকারেরা বসতে পারবেন না।
ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।