১৯৪৫ সালে ৩ মে মার্কিন সেনার তোলা এমনই কিছু ছবির প্রদর্শন চলছে কলকাতায়।
গুছিয়ে রাখা ছিল। কাগজে মুড়ে, একটি বাক্সের মধ্যে। পড়ার ঘরের দেওয়াল আলমারিতে। তার পরে বয়ে গিয়েছে অনেকটা সময়। বাক্সের মধ্যে সযত্নে রাখা ১৩০টি খাম। প্রতিটি খামের মধ্যে বন্দি টুকরো টুকরো পল্লিবাংলা। সেই বাক্স নিয়েই সুদূর শিকাগো থেকে কলকাতায় এসেছেন অ্যালান টেলর এবং জেরি জেব্রিয়াল। সেই সব ছবি নিয়ে কলকাতার বিড়লা অ্যাকাডেমিতে চলছে প্রদর্শনী। নাম ‘ফলোয়িং দ্য বক্স’।
শিকাগোর লেক ফরেস্ট কলেজের নৃতত্ত্বের অধ্যাপক দম্পতি অ্যালান এবং জেরির বর্তমান ঠিকানা দক্ষিণ কলকাতায়। এক সাক্ষাত্কারে জেরি জানালেন পল্লিবাংলার ছবি ভর্তি বাক্সের রহস্য। বললেন, “পঁচিশ বছর আগে শিকাগোয় মাত্র ২০ ডলার দিয়ে কিনেছিলাম সেই বাক্স। তখনও জানতাম না কী খাজানা অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।” পরে গবেষণা করে জানতে পারেন, ছবিগুলি ভারতে তোলা হয়েছিল। সেটাও প্রায় সত্তর বছর আগে, ১৯৪৫ সালে।
অনেকের সঙ্গে কথা বলার পরে আমেরিকার একটি সংগ্রহশালায় গিয়ে জানতে পারেন ছবিগুলি পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরে তোলা হয়েছিল। এবং তুলেছিলেন এক মার্কিন সৈনিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তিনি বেশ কিছু দিন কাটিয়েছিলেন খড়্গপুরের সালুয়া বিমানঘাঁটিতে।
ফোটোগ্রাফি এবং নৃতত্ত্বের অধ্যাপক জেরি জানালেন, বাক্সটির ভিতরে ১৩০টি খামে ছিল ৪ ইঞ্চি এবং ৫ ইঞ্চি সাইজের কিছু নেগেটিভ। প্রতিটি নেগেটিভের নীচে ইংরেজিতে লেখা ‘১৯৪৫, ইন্ডিয়া’। সেই সব নেগেটিভ প্রথমে শিকাগোর ওই নৃতত্ত্ববিদ দম্পতির মনে আগ্রহ তৈরি করতে না পারলেও পরে ২০০৪ সালে একটি আলোকচিত্র সংক্রান্ত কর্মশালায় যোগ দিতে গিয়ে লেক ফরেস্ট কলেজের অধ্যাপকের মনে পড়ে যায় ছবি ভর্তি ওই বাক্সের কথা।
সেই কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী ছাত্রী গওয়ান মাইবেকের মনে তৈরি হয় উত্তেজনা। প্রথম তাঁরই মনে প্রশ্ন ওঠে, ভারতের ঠিক কোথায় তোলা হয়েছিল এই ছবিগুলি? শুরু হয় গবেষণা। বিভিন্ন মার্কিন সংগ্রহশালা এবং নানা গ্রন্থাগার ঘেঁটে জানা যায়, ছবিগুলি পশ্চিমবঙ্গে তোলা হয়েছিল।
পরে ২০১১ সালে অ্যালান এবং জেরির ছেলে বৃত্তি পেয়ে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিখতে আসেন পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার কাছে। আর দেরি না করে ছেলের সঙ্গে তাঁরাও চলে আসেন ভারতে। পরে ২০১৩ সালে জেরি এবং অ্যালান গবেষণার জন্য বৃত্তি নিয়ে আবার ফিরে আসেন ভারতে। এ বার পশ্চিমবঙ্গে। জানতে পারেন, মেদিনীপুরে তোলা হয়েছে ওই সব ছবি। তথ্যের জন্য তাঁরা ঘুরে বেড়ান মেদিনীপুরের বিভিন্ন এলাকায়। ছবিগুলি দেখান স্থানীয় বাসিন্দাদের। ছবির মন্দিরগুলি এখনও রয়েছে ঠিক সে ভাবেই। কথায় কথায় ওই দম্পতি বললেন, “অবাক হয়েছিলাম এক যুবক যখন ছবিতে চিনতে পেরেছিলেন নিজের ঠাকুরদাকে।”
এর আগে ২০১২ সালে স্কটল্যান্ডের এক সংগ্রহশালায় শতাব্দীপ্রাচীন সংগ্রহ থেকে হঠাত্ই দেখা মিলেছিল পুরনো কলকাতার এক ঝলক। ভারতে তখন ব্রিটিশ রাজ। সাল ১৯১২। সস্ত্রীক কলকাতায় এসেছেন সম্রাট পঞ্চম জর্জ। সাজ সাজ তখনকার কলকাতায়। হুগলি নদী বেয়ে জাহাজ ভিড়ছে চাঁদপাল ঘাটে। কোথাও আবার হাওড়া স্টেশন চত্বরের ছবি।
আর এ বার অ্যালান এবং জেরির সংগ্রহে দেখা মিলল ১৯৪৫ সালের মন ভাল করে দেওয়া কিছু খণ্ডচিত্রের। যদিও সে সময়ের ইতিহাস বড় কঠিন। এক দিকে চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, অপর দিকে ১৯৪৩ সালে বাংলায় দুর্ভিক্ষের ছায়া এবং স্বাধীনতা পাওয়ার অদম্য ইচ্ছে। এ সবের বাইরেও তখনকার মানুষের জীবনযাপন দেখে আসতে হলে এক বার ঢুঁ মারতেই হবে বিড়লা অ্যাকাডেমিতে।
৭ তারিখের মধ্যে।
কথা প্রসঙ্গে জেরি জানালেন, কলকাতায় তাঁদের এই প্রদর্শনীতে রয়েছে আরও কিছু বাঙালি শিল্পীর কাজ। এর পরে তাঁদের গন্তব্য দিল্লি। তবে তাঁদের ইচ্ছে, ভারতের অন্যান্য শহরেও প্রদর্শনী করার। আর এ সবের পরে সেই বাক্স শিকাগো ঘুরে পৌঁছে যাবে নিউ ইয়র্কে।