বোনের খোঁজে আজও এ শহরে আসেন বাংলাদেশি বৃদ্ধা

এত বছরেও হাল ছাড়েননি। হারিয়ে যাওয়া ছোট বোনের খোঁজে আবার কলকাতা ঘুরে গেলেন ঢাকার বাসিন্দা পঁচাত্তর পার করা ফয়জুন্নিসা খানম, গত ৪৩ বছরে এই নিয়ে ৪৩ বার! কোনও বিরতি না দিয়ে। আর প্রতিবারের মতো এ বারও প্রিয়জনকে ফিরে পাওয়ার আশা জিইয়ে রেখে ফিরতি বিমান ধরলেন।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৪ ০২:৫৩
Share:

(বাঁ দিকে) মনারা। (ডান দিকে) বোনের ছবি হাতে সোনারা। —নিজস্ব চিত্র।

এত বছরেও হাল ছাড়েননি। হারিয়ে যাওয়া ছোট বোনের খোঁজে আবার কলকাতা ঘুরে গেলেন ঢাকার বাসিন্দা পঁচাত্তর পার করা ফয়জুন্নিসা খানম, গত ৪৩ বছরে এই নিয়ে ৪৩ বার! কোনও বিরতি না দিয়ে। আর প্রতিবারের মতো এ বারও প্রিয়জনকে ফিরে পাওয়ার আশা জিইয়ে রেখে ফিরতি বিমান ধরলেন।

Advertisement

কাছের মানুষের হঠাৎ অন্তর্ধানে দিশেহারা হওয়া স্বাভাবিক। প্রাথমিক ধাক্কার জের কাটিয়ে তাঁর সন্ধানে দশ দিক, দিন-রাত এক করে দেওয়ার মধ্যেও আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু তার পরেও যদি খোঁজ না মেলে? মনে জোর রেখে কত দিন, কত বছর অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়া সম্ভব?

পারা-না পারার সব হিসেব ওলটপালট করে দিয়েছেন বাংলাদেশের ফয়জুন্নিসা ওরফে সোনারা। সম্পর্কে লেখক সৈয়দ মুজতবা আলির বেয়ান সোনারা ৪২ বছরেও ক্লান্ত হননি, লড়াই ছাড়েননি। লালবাজারের মিসিং পার্সন্স স্কোয়াডের অফিসারেরা জানিয়েছেন, ৬-৭ বছর পর্যন্ত হারানো আত্মীয়ের জন্য মানুষ এসে খোঁজ নিচ্ছেন, তদ্বির করছেন এমন অভিজ্ঞতা তাঁদের রয়েছে। কিন্তু প্রায় চার যুগ ধরে যে এই উদ্যম জিইয়ে রাখা যায়, সেটা অভাবনীয়!

Advertisement

অশক্ত শরীরে ফয়জুন্নিসা গত এপ্রিলেও ফের কলকাতায় এসেছিলেন। খবরের কাগজে ‘নিখোঁজ’ কলমে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন ‘১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঠিক পরে রাজশাহী অঞ্চল থেকে নিখোঁজ শ্রীহট্টের মনারা চৌধুরীর খোঁজ কেউ দিলে বাধিত হইব।’

৪৩ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া এক জনকে খুঁজতে বিজ্ঞাপন!

এখন কানে ভাল শোনেন না, চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ, স্মৃতিও অনেকটা ঝাপসা কিন্তু সোনারার অটুট আত্মবিশ্বাস কলকাতাই ফিরিয়ে দেবে তাঁর থেকে প্রায় ১০ বছরের ছোট বোন মনারাকে। হাতের মুঠোয় ধরা বহু বছর আগে তোলা মনারা চৌধুরীর একটা সাদা-কালো মলিন হয়ে যাওয়া ছবি নিয়ে এ বারও তিনি গিয়েছেন কলকাতার একাধিক থানায়। অফিসারেরা কী বলবেন বুঝে পাননি। ছবির মনারার বয়স মেরেকেটে ১৯-২০। রোগাপাতলা চেহারা, মাঝখানে সিঁথি কেটে চুল আচড়ানো, বাঁ হাতে ঘড়ি। এই ছবি দেখে এখনকার মনারাকে খুঁজে পাওয়া যাবে কী করে?

বৃদ্ধা ছলছলে চোখে অসহায়ের মতো বলেন, “আমার কাছে ওর আর কোনও ছবি তো নেই। এটা বিয়ের আগে আমাদের গোপালগঞ্জের স্টুডিওয় তোলা। এর দেড় বছরের মধ্যে ওর বিয়ে হয়ে গেল, আর তার দু’বছরের মধ্যেই ও হারিয়ে গেল! সবাই বলে, ও আর ফিরবে না। বলল, হয়তো ও মারা গিয়েছে। আমার মন তো মানতে চায় না। আমি মরে যাওয়ার আগে নিশ্চয়ই ওঁর সঙ্গে দেখা হবে।” বলে চলেন, “সেই ’৭২ সালে গোপালগঞ্জে আমাদের পাড়ার এক জন কলকাতায় এসেছিলেন। ফিরে গিয়ে জানালেন, বাসের জানলা দিয়ে কলকাতার রাস্তায় নাকি মনারার মতো এক জনকে দেখেছেন। এর পর কি আমি চুপ করে থাকতে পারি? ওকে কোলে করে গোটা পাড়ায় ঘুরে বেড়িয়েছি, স্নান করিয়েছি। শান্ত ছিল, খিলখিলিয়ে হাসত। চোখ বন্ধ করলে সব মনে পড়ে যায় যে। ওর গলাটা কানে বাজে।”

১৯৭১-এর টালমাটাল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সদ্য স্বাধীনতার পর নাটকীয় ভাবে নিখোঁজ হন বছর তেইশের মনারা। ফয়জুন্নিসা বিবৃতিতে, উর্দুভাষী মুসলিম মজহরউদ্দিনের সঙ্গে বিয়ে হয় মনারার। খুব সুখে ছিলেন দু’জন রাজশাহীতে। মজহর ছিলেন পুলিশবাহিনীতে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে ভারতীয় সেনার হাতে বন্দি হয়ে বহরমপুর জেলে যান। ধরা পড়বেন বুঝতে পেরেই মজহর স্ত্রীকে দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন সহকর্মী টিটু মিয়াঁর উপরে। কিন্তু মনারার বাড়ির লোকের বক্তব্য, টিটু দায়িত্ব পালন করেননি। মনারার সঙ্গে তাঁদের আর কোনও দিন যোগাযোগ হয়নি।

এর বেশ কিছুদিন পরে পাকিস্তান থেকে মজহরের একটি চিঠি এসেছিল। সেটাই তাঁর পাঠানো শেষ চিঠি। তাতে তিনি লেখেন, বহরমপুরের জেলে মনারা নাকি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, কিন্তু তাঁকে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি আর স্ত্রীর খোঁজ পাননি। কোনওটা সত্যি, কোনটা মিথ্যা যাচাই করতে পারেনি ভিনদেশে থাকা মনারার পরিবার।

ফয়জুন্নিসা ওরফে সোনারার জামাই অর্থাৎ সৈয়দ মুজতবা আলির বড় ছেলে সৈয়দ মুশারফ আলির কথায়, “১৯৭৭ সালে আমার বিয়ে হয় ওঁর মেয়ে জাবেদার সঙ্গে। তার পর থেকেই আমি দেখছি শাশুড়ি মা তাঁর বোনকে খুঁজে চলেছেন। ওঁর তিন ভাই বেঁচে আছেন। তাঁরা হাল ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু ফয়জুন্নিসাকে দমানো যায়নি।” তিনি বলেন, “অনেক বার আমার সঙ্গেই উনি কলকাতায় গিয়েছেন। চেনা-পরিচিত কেউ কলকাতায় যাচ্ছেন শুনলেই তাঁকে বোনের সম্পর্কে জানান। ছবি দিয়ে দেন। কোনও তথ্য পেলে জানাতে বলেন। আমরা জানি এত বছর পরে এ সব অর্থহীন। কিন্তু এত আকুল হয়ে থাকেন যে, আমরা কেউ বাধা দিতে চাননি।”

দুনিয়া কত কী আশ্চর্য ঘটনা তো ঘটে। সবাইকে ভুল প্রমাণ করে মনারা ফিরে আসবেন, তার পরে দু’জনে মিলে যাবেন গোপালগঞ্জে আব্বা-র ভিটেয়। পা ছড়িয়ে দালানে বসে গল্প করবেন ৪৩ বছর ধরে অপেক্ষায় আছেন সোনারা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন