ব্যাঙ্কের ভিতরে নজর-ক্যামেরায় বন্দি কেপমারি

এ যেন সম্মোহনের খেলা! তবে ম্যাজিকের মঞ্চে নয়। শহরের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ভিতরে! খেলোয়াড়েরাও কেউ পেশাদার জাদুকর নয়। কেপমার! এই কেপমারদের পাল্লায় পড়েই গত শনিবার দশ হাজার টাকা খুইয়েছেন বাঘা যতীনের বাসিন্দা এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৪ ০৬:৫৮
Share:

(বাঁ দিক থেকে) ছবি ১ এবং ২: ব্যাঙ্কের প্রবেশদ্বারের সামনেই বসে আছেন নিরাপত্তারক্ষী। পাশেই চেয়ারে পেনশনের টাকা গুনছেন এক বৃদ্ধ। তাঁর পিছনে ও বাঁ দিকে দুই কেপমার। পিছনে দাঁড়ানো লোকটি হাত বাড়িয়ে বৃদ্ধকে একটি নোট দেখায়। তাতে বৃদ্ধ অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়ায় তাঁর কোলে রাখা টাকা তুলে নেয় অন্য কেপমার। চালান করে দেয় সঙ্গীর হাতে। ছবি ৩: ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে এক কেপমার। টাকা হাতে নিয়ে বেরোতে প্রস্তুত অন্য জনও। ব্যাঙ্কের সিসিটিভি ক্যামেরায় ওঠা ফুটেজ থেকে।

এ যেন সম্মোহনের খেলা! তবে ম্যাজিকের মঞ্চে নয়। শহরের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ভিতরে! খেলোয়াড়েরাও কেউ পেশাদার জাদুকর নয়। কেপমার!

Advertisement

এই কেপমারদের পাল্লায় পড়েই গত শনিবার দশ হাজার টাকা খুইয়েছেন বাঘা যতীনের বাসিন্দা এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। গোটা ঘটনাই ধরা পড়েছে ব্যাঙ্কের সিসিটিভি-তে। ঘটনার তদন্তে নেমেছে পুলিশ। যদিও বুধবার রাত পর্যন্ত তারা কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।

রতনকুমার বর্ধন নামে ওই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জানান, গত শনিবার সকাল দশটা নাগাদ একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের যাদবপুর শাখায় পেনশন তুলতে গিয়েছিলেন তিনি। কাউন্টার থেকে তিরিশ হাজার টাকা তোলার পরে ব্যাঙ্কের ভিতরেই একটি চেয়ারে বসে কোলে রাখা ব্যাগের উপরে টাকা রেখে গুনতে শুরু করেন রতনবাবু। সে সময়ে তাঁর বাঁ দিকে গা ঘেঁষে দাঁড়ায় ধূসর স্ট্রাইপড শার্ট ও কালো প্যান্ট পরা এক যুবক। রতনবাবু বলেন, “লোকটি হঠাৎই ঝুঁকে পড়ে আমার টাকার বান্ডিলে হাত বোলাতে শুরু করে। তার সঙ্গে দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু বলতে থাকে।”

Advertisement

সিসিটিভি-র ফুটেজে ধরা পড়েছে, ঠিক এ সময়েই পিছনে এসে দাঁড়ায় সাদা শার্ট-বাদামি প্যান্ট পরা কালো, মাঝারি চেহারার মাঝবয়সী একটি লোক। পিছন দিক থেকে প্রায় রতনবাবুর গায়ে ঝুঁকে টাকাগুলো দেখতে থাকে সে। রতনবাবু জানান, বাঁ দিকে দাঁড়ানো যুবকের আচরণ দেখতে দেখতে যেন কিছুটা সম্মোহিত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। একটা অচেনা লোক তাঁর টাকায় হাত দেওয়া সত্ত্বেও কিছুই বলতে পারছিলেন না ওই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক।

সিসিটিভি-র ফুটেজে ধরা পড়েছে, সকাল ১০টা ২৮ মিনিটে যুবকটি যখন টাকায় হাত বোলাচ্ছে, তখনই পকেট থেকে ১০০ টাকার একটি নোট বার করে পিছনে দাঁড়ানো লোকটি। রতনবাবুর কাঁধের উপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে টাকাটি সামনের দিকে নিয়ে যায়। রতনবাবু বলেন, “পিছনের লোকটি আমার কাঁধের উপর দিয়ে হাত এনে একটি একশো টাকার নোট দেখাতে থাকে। আমার নজরও সে দিকে ঘুরে যায়।” এর পরেই রতনবাবু খেয়াল করেন, তাঁর কোল কিছুটা হাল্কা ঠেকছে। তাকিয়ে দেখেন, ৫০০ টাকার কুড়িটি নোট উধাও! পাশে দাঁড়ানো যুবক, পিছনে দাঁড়ানো লোকটিও নেই। সিসিটিভি-র ফুটেজ বলছে, ১০০ টাকার নোট দেখানো থেকে শুরু করে টাকা হাতিয়ে নেওয়া গোটা ঘটনাটিই ঘটেছে মাত্র ২৫ সেকেন্ডের মধ্যে!

দুষ্কৃতীরা টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়েছে, এটা বোঝার পরেই রতনবাবু ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের কাছে গিয়ে ঘটনাটি জানান। সেখানেই পুরো ঘটনা সিসিটিভি-তে দেখেন তিনি। ওই ফুটেজেই ধরা পড়েছে, পিছনে দাঁড়ানো লোকটি টাকা দেখানোর সময়ে রতনবাবু অন্যমনস্ক হয়েছিলেন। সেই সুযোগে পাশে দাঁড়ানো যুবক বাঁ হাত দিয়ে তাঁর কোল থেকে টাকা তুলে নেয়। সেই হাত ঘুরিয়ে এনে টাকা চালান করে পিছনের লোকটিকে। এর পরেই গুটি গুটি পায়ে ব্যাঙ্ক ছেড়ে বেরিয়ে যায় যুবকটি। পিছু পিছু সাদা হাফশার্ট পরা মাঝবয়সী লোকটিও।

ব্যাঙ্কের ভিতরে কেপমারির এই ঘটনা নিয়ে ম্যানেজারকে লিখিত অভিযোগ করেছেন রতনবাবু। অভিযোগ দায়ের করেছেন পাটুলি থানাতেও। সিসিটিভি ফুটেজে ওই যুবক ও মাঝবয়সী লোকটি ছাড়াও রতনবাবুর আশপাশে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা এক বৃদ্ধের সন্দেহজনক গতিবিধি নজরে পড়েছে। ওই দু’টি লোকের পিছু পিছু ওই বৃদ্ধও ব্যাঙ্ক ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছেন। তদন্তকারীরা মনে করছেন, কেপমারি চক্রে ওই বৃদ্ধও জড়িত। তবে ঘটনায় তাঁর সরাসরি কোনও যোগ সিসিটিভি ফুটেজে মেলেনি বলেই পুলিশ সূত্রের খবর। এর সঙ্গে আরও একটি বিষয় নজরে পড়েছে পুলিশের। তদন্তকারীরা জানান, রতনবাবু ও ওই দুই কেপমারের খুব কাছেই বসে ছিলেন ব্যাঙ্কের নিরাপত্তারক্ষী। সিসিটিভি ফুটেজে তা ধরাও পড়েছে। কাছে বসে থাকা সত্ত্বেও কেপমারির ঘটনা কী ভাবে তাঁর নজর এড়িয়ে গেল, তা-ও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।

লালবাজার সূত্রের খবর, পাটুলি থানার পাশাপাশি গোয়েন্দা বিভাগও ঘটনাটি নিয়ে খোঁজখবর করছে। সিসিটিভি-র ফুটেজে যে সব দুষ্কৃতীর ছবি ধরা পড়েছে, তার সঙ্গে প্রাথমিক ভাবে পরিচিত কেপমারদের ছবির মিল এখনও খুঁজে পাননি গোয়েন্দারা। পুলিশের একটি অংশের মতে, দক্ষিণ শহরতলি এলাকায় এই ধরনের অপরাধচক্র বাড়ছে। অনেক সময়েই দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার দুষ্কৃতীরা এই এলাকাগুলিতে অপরাধ করে চম্পট দিচ্ছে। এ দিনের কেপমারির দুষ্কৃতীরাও তেমন কোনও চক্রের সদস্য বলেই তদন্তকারীরা মনে করছেন। কলকাতা পুলিশের এক কর্তার দাবি, “তদন্তে কিছু সূত্র মিলেছে। দুষ্কৃতীরা শীঘ্রই ধরা পড়বে বলে আশা করছি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন