বন্ধুদের প্রেমপত্র লিখে দেওয়ার মজাই ছিল আলাদা

বাদুবাগান লেন— উত্তর কলকাতার এক অখ্যাত গলি। সেখানেই এক অতি সাধারণ ভাড়াবাড়িতে আমার জন্ম। একতলায় বারোয়ারি কলতলা আর শ্যাওলা ধরা চৌবাচ্চা— সিঁড়ির নীচে টিনের একচিলতে দরজার আড়ালে রাজ্যের মাকড়সা, টিকটিকি আর ঝুল পড়া মেয়েদের সেকেলে রান্নাঘর, অন্ধকার ও বিভীষিকাময়। সেখানেই গাদাগাদি করে আমাদের যৌথ পরিবারের ‘সুজন’রা দিব্যি থাকতাম। বাড়িটাকে ঘিরে আমার জীবনের প্রথম দশ বছরের ছবি এখনও স্বপ্নে ফিরে আসে বার বার।

Advertisement

ইন্দ্রাণী সেন

শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০০
Share:

বাদুবাগান লেন— উত্তর কলকাতার এক অখ্যাত গলি। সেখানেই এক অতি সাধারণ ভাড়াবাড়িতে আমার জন্ম। একতলায় বারোয়ারি কলতলা আর শ্যাওলা ধরা চৌবাচ্চা— সিঁড়ির নীচে টিনের একচিলতে দরজার আড়ালে রাজ্যের মাকড়সা, টিকটিকি আর ঝুল পড়া মেয়েদের সেকেলে রান্নাঘর, অন্ধকার ও বিভীষিকাময়। সেখানেই গাদাগাদি করে আমাদের যৌথ পরিবারের ‘সুজন’রা দিব্যি থাকতাম। বাড়িটাকে ঘিরে আমার জীবনের প্রথম দশ বছরের ছবি এখনও স্বপ্নে ফিরে আসে বার বার।

Advertisement

দোতলার ছোট্ট ঘরে মা গান শেখাতে বসতেন। আমাকে নয়, ছাত্রীদের। আমার কাজ ছিল মায়ের কাজ শেষ হলে আমার ‘মাতৃসমা’ ছাত্রীদের হারমোনিয়ামে সে গান তোলানো। পাঁচ বছর বয়সে প্রথম আকাশবাণীর শীত-শীত করা ‘শিশুমহল’এর ঠান্ডা ঘরে আর রবীন্দ্রকাননে দশ হাজার শ্রোতার সামনে গাইলাম, ‘কেন তোমরা আমায় ডাকো’। বেলোতে হাত পেতাম না বলে মা-ই সে বার হারমোনিয়াম বাজালেন। গড়পারের রামমোহন লাইব্রেরির মঞ্চে প্রথম নাচলাম ‘চণ্ডালিকা’য়, তাও এক মিনিটের নাচ। রাজ অনুচরের চরিত্রে। মা-র কাছে শেখা ভজন, ভাটিয়ালি আর রবীন্দ্রসঙ্গীত উগরে ‘ইন্টার-স্কুল-সঙ্গীত প্রতিযোগিতা’য় পেয়ে গেলাম মা সরস্বতীর মূর্তি, রুপোর তৈরি।

ছোটবেলায় মণিকাকুর হাত ধরে কালীপুজোর দিনে মানিকতলার সুকিয়া স্ট্রিটে নাড়ুর দোকান থেকে হাতভর্তি রংমশাল, ফুলঝুরি, সাপবাজি কিনে বাড়ি ফিরতাম। আবার বিশ্বকর্মা পুজোর বিকেলে সারা আকাশ রঙিন হয়ে উঠত। সেই সব দিন কোথায় যেন হারিয়ে গেল!

Advertisement

আমার টিন-এজে প্রথম ছবি দেখা প্রাচী সিনেমা হলে। ছোটকাকুর সঙ্গে ‘বালিকা বধূ’। সেখানে প্রথম নায়ক নায়িকার প্রেমের দৃশ্যে রোমাঞ্চিত হতে হতে কখন যেন বয়ঃসন্ধির ‘নিষিদ্ধ’ জগতে পৌঁছে গেলাম। আমার কৈশোর কেটেছে রাইফেলরেঞ্জ রোডে। ঈদের দিনে খোলা রাস্তায় বিরাট বিরাট হাঁড়িতে মাটন বিরিয়ানি রান্না হত। চার দিকে গন্ধ ম-ম করত। পুজোর সময় পাড়ার দুর্গাপুজোর মাইকে দু’কলি আশাজি বা মান্নাদা গাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে প্রথম ঠাকুর দেখতে বেরোনো, অষ্টমীর অঞ্জলিতে ইচ্ছে করে পাড়াতুতো দাদাদের হাতে হাত ছোঁয়ানো, গোখেল স্কুলে নতুন বন্ধু জুটিয়ে তাদের প্রেমপত্র লিখে দেওয়া। এ সবের সঙ্গেই জর্জ বিশ্বাস আর বিভূতি দত্তের কাছে তালিম নেওয়ার সুবাদে শুরু হল কলকাতার অলিগলি, রাস্তাঘাট চেখে বেড়ানো।

একটু উঁচু ক্লাসে উঠে রঙিন খামে যত্নে লেখা অজস্র ভুল বানানে লেখা প্রেমপত্রও পেতে শুরু করলাম। কিন্তু সে সময় প্রেমে পড়াটা এতটাই নিষিদ্ধ বস্তু ছিল, যে পত্রপাঠ সেগুলো মায়ের হাতে তুলে দেওয়াটাই উচিত বলে মনে হয়েছিল। তখন বাড়িতে নিয়মিত আসত বেতার জগৎ।

১৯৭৪-এ স্কুল জীবন শেষ হল। অর্থনীতি নিয়ে ভর্তি হলাম ব্রেবোর্ন-এ। পড়তে পড়তেই বিয়ে হয়ে গেল। বদলে গেল জীবনটাও।

কালীঘাটের কালীমন্দির আর মহাশ্মশান থেকে এই বাড়িটা ছিল একেবারে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে। রাত জেগে বি এ পরীক্ষার পড়া করতে করতে ‘বলহরি হরিবোল’ শব্দে চমকে উঠতাম। দু’কামরার ভাড়া বাড়িটার রান্নাঘর ছিল সিঁড়ির তলায়। গঙ্গায় বান এলে সেই জলে ভেসে আসত পোকামাকড়, সাপখোপও। তাই চব্বিশ ঘণ্টাই আলো জ্বেলে রাখতে হত। তবে সামনে একটা চমৎকার উঠোন ছিল। সেখানে শীতের দুপুরে রোদ্দুর মেখে বহু সুনীল-সমরেশ-শীর্ষেন্দু শেষ করেছি। সঙ্গে অনুপান থাকত শাশুড়ির বানানো কুল/তেঁতুলের চুরি করা আচার।


রাশিদ খান এবং ইন্দ্রাণী সেন

তত দিনে গুরু পূরবী দত্ত, বিমান মুখোপাধ্যায়ের শিক্ষায় এবং বাবার অদম্য উৎসাহে গান আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গিয়েছে। সেন পরিবারের শিক্ষাগত ঐতিহ্য বজায় রাখতে চালিয়ে গিয়েছি লেখাপড়াও। অধ্যাপনার শুরু হাজরা মোড়ের যোগমায়া ও বাসন্তী দেবী কলেজে। তার পর ১৯৮২ থেকে টানা ৩৩ বছর বাগবাজারের উইমেনস কলেজে। এর মধ্যেই ২১ বছর বয়সে জীবনে এসেছে নতুন অতিথি, কন্যা রুক্মিণী।

আমার জীবনের গতির সঙ্গে কলকাতাও দ্রুত বেড়ে উঠেছে। চলমান ফোন, ফাস্ট ফুড, শপিং মল, বিশাল ফ্লাইওভার। কলকাতার সাংস্কৃতিক জগৎ চিরকালই ঐতিহ্যময়। রবীন্দ্র-নজরুলের হাত ধরে এই শহর ধীরে ধীরে সাবালক হয়ে উঠেছে সলিল-সুধীন-হেমন্ত-মান্নার সুরে। গানের সুবাদেই ১৯৭৬-এ এইচ এম ভি-তে গান গাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। শুরু করেছি রবীন্দ্র গান দিয়ে। ধীরে ধীরে ৮০-র দশকে বিভিন্ন ধারার গান গেয়েছি। ৯০-এর সূচনায় কলকাতা ভাসল নতুন ধরনের গানে— জীবনমুখী, রিমেক। এই সময়েই আমার সাংগীতিক ও শিক্ষাগত পরিচিতিরও উত্তরণ ঘটল। দশ বছরের অর্থনীতির গবেষণার শেষে নামের আগে ‘ডক্টর’ বসল। আর গান ‘ভালোবাসি ভালোবাসি’র জ়ন্য জ়ুটল উজ্জ্বল সম্মান আর অঢেল শ্রদ্ধা।

গানের তরণীতে...

বাঁ দিক থেকে সুমিত্রা সেন, শ্রাবণী সেন, ইন্দ্রাণী সেন, স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত এবং লোপামুদ্রা মিত্র।

আমার বর্তমান আবাস দক্ষিণের একটি এলিট অধ্যুষিত অঞ্চলে। এখানে কলকাতা একেবারে অন্য রকম। অভিজাত, ঝকঝকে, মালিন্যহীন। জানলা খুললেই আকাশ আর মেঘ হাত ধরাধরি করে ঢুকে পড়ে। বছরভর কোকিল আর পাখির ডাক মনে করিয়ে দেয়— ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত।’ কখন যে নরম সূর্য পশ্চিমে ভিক্টোরিয়ার কালো পরীটার আড়ালে টুপ করে ডুবে যায় বুঝতে পারি না। আকাশ কালো করে বছরের প্রথম কালবৈশাখী সগর্জনে আছড়ে পড়ে জানলার শার্সিতে, দক্ষিণে দূরদর্শনের লাল বাতি আর আর সাউথ সিটির উচ্চাশা ও অহংকারকে পিষে মাড়িয়ে ছুটে আসে প্রথম বৃষ্টি। আর পূর্ণিমাতে ঘর অন্ধকার করে যখন একা, তখন দিগন্ত ভাসানো চাঁদের আলো আমার জানলার গ্রিল ভেঙে, টুকরো টুকরো হয়ে, কেমন একটা জ্যামিতিক নকশা রচনা করে ঘরের দেওয়ালে। পাশের বাড়ির এফ এম রেডিও থেকে মোহরদি’র মধুকণ্ঠে ভেসে আসে— ‘‘ভরি দিয়া পূর্ণিমা নিশা/ অধীর অদর্শন তৃষা/ কি করুণ মরীচিকা আনে আঁখি পাতে/ বিরহ মধুর হল আজি মধুরাতে।’’

এই আমার সাধের কলকাতা।

লেখক: সঙ্গীতশিল্পী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন