মাছবাজারের বরফেও জমছে লস্যি-আইসক্রিম

স্টেশন থেকে বেরোনোর মুখে লস্যি, আইসক্রিমের হাঁকডাক। বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকা খুদেটি বায়না ধরল লস্যি কিনে দেওয়ার জন্য। ছেলের আবদার মেটানোর পাশাপাশি বাবা-মা নিজেরাও কিনে খেলেন লস্যি। গোখেল মেমোরিয়াল স্কুল। প্রচণ্ড গরমে কাহিল পড়ুয়ারা। স্কুল থেকে বেরোতেই আইসক্রিম বিক্রেতাকে দেখে ঝাঁপিয়ে পড়ল সকলে।

Advertisement

অভীক বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৪ ০০:১২
Share:

জমাট বাঁধা বিপদ। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

স্টেশন থেকে বেরোনোর মুখে লস্যি, আইসক্রিমের হাঁকডাক। বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকা খুদেটি বায়না ধরল লস্যি কিনে দেওয়ার জন্য। ছেলের আবদার মেটানোর পাশাপাশি বাবা-মা নিজেরাও কিনে খেলেন লস্যি।

Advertisement

গোখেল মেমোরিয়াল স্কুল। প্রচণ্ড গরমে কাহিল পড়ুয়ারা। স্কুল থেকে বেরোতেই আইসক্রিম বিক্রেতাকে দেখে ঝাঁপিয়ে পড়ল সকলে।

প্রচণ্ড গরমে ঠান্ডা পানীয়, লস্যি অথবা আইসক্রিমের দিকে ঝোঁক থাকে প্রায় সকলেরই। বড় থেকে ছোট, অনেকেই রাস্তায় কম দামে পাওয়া আইসক্রিম, গোলা কিনে খেতে পছন্দ করেন। হকারদের বিক্রিও বাড়ে হু হু করে। কিন্তু রাস্তায় এই আইসক্রিম বা গোলা কিনে খাওয়া কতটা নিরাপদ? এই আইসক্রিম, লস্যি বা গোলার ব্যবহৃত বরফ আসে কোথা থেকে?

Advertisement

শহর ঘুরে জানা গেল অজানা অনেক তথ্য। কথা বলা গেল ধর্মতলা এবং পার্ক সার্কাসের কয়েক জন লস্যি, আইসক্রিম বিক্রেতার সঙ্গে। বেশির ভাগেই জানালেন, তাঁরা নিজেরাই বরফ কিনে আনেন। আবার অনেক সময়ে বরফ বিক্রেতাও পৌঁছে যান তাঁদের কাছে। কত দাম পড়ে এই বরফের? শেখ মামুদ নামে এক লস্যি বিক্রেতা জানান, এক সিকি অর্থাৎ তিন কেজি বরফের দাম পড়ে ২০ থেকে ২৫ টাকা। প্রতিদিন প্রায় তিন থেকে পাঁচ সিকি বরফ লাগে তাঁর।

নিউ মার্কেটের এক বরফ বিক্রেতা জানালেন, বড়বাজার অঞ্চল থেকে প্রতি দিন ১০০-১৫০ কেজি বরফ কিনে আনেন তিনি। তার পরে রাস্তায় রেখেই তা বিক্রি করেন। মাছের বাজার থেকে রাস্তার আইসক্রিম, লেবুজল, লস্যি বিক্রেতা বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করেন সেই বরফ। আর যদি অত বরফ না পাওয়া যায়? গলা নিচু করে ওই বিক্রেতা বলেন, “তখন এ দিকের জিনিস ও দিকে সাপ্লাই দিই।” মানে? তিনি জানান, গরমে বরফ তো কম পড়েই। দামও বাড়ে। তাই অনেক সময়ে সকালে সরবরাহ করা মাছের বাজারের বরফ ফেরত নিয়ে এসে ফের বিক্রি করে দেন খোলা বাজারে আইসক্রিম, লস্যি বিক্রেতাদের কাছে।

কোথায় কোথায় পাওয়া যায় এ সব বরফ? নিউ মার্কেটের চ্যাপলিন স্কোয়ারে, চাঁদনি চকের প্রিন্সেপ স্ট্রিটে, পার্ক সার্কাস মোড়ে গেলেই দেখা মিলবে খোলা রাস্তায় বিক্রি হওয়া বরফের। পার্ক সার্কাস মোড়ের পাশে ডাঁই করে রাখা রয়েছে বিশাল বিশাল বরফের চাঁই। প্লাস্টিকে ঢাকা ওই বরফ কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর শাবল দিয়ে মেরে নিয়ে যাচ্ছেন দু’এক জন। তা বিক্রি করছেন পাশের আইসক্রিমের বা গোলার দোকানে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই বরফের মালিক জানান, এই বরফ তাঁরা কখনও রাজাবাজার আবার কখনও মাছের বাজার থেকে নিয়ে আসেন। ধর্মতলায় নিউ মার্কেটের পাশেও নজরে পড়ে ঠেলায় বা গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বরফের চাঁই। একই দৃশ্য গোলপার্ক, গড়িয়াহাটেও। শহরের বিভিন্ন জায়গাতেই এই ভাবে খোলাখুলি নিয়ে যাওয়া হয় বরফ।

এই বরফ আদৌ খাওয়ার উপযোগী কি? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ বিভাগের প্রধান উৎপল রায়চৌধুরীর কথায়, মাছ বা ফল সংরক্ষণে প্রধানত এই সমস্ত বরফ ব্যবহার হয়। ফুটপাথে খোলাখুলি ভাবে বিক্রি হওয়া এই বরফে জীবাণু সংক্রমণের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য ব্যবহৃত এই বরফ বরফকলে তৈরি হয়। সেই কারণে খনিজ উপাদানের মাত্রার দিকে খেয়াল রাখা হয় না। অশুদ্ধ বরফে সংক্রমণের আশঙ্কা তো থাকেই, এ ছাড়া ওই বরফ মাছ বা মৃতদেহের উপর থেকে নিয়ে এসে পুনরায় বিক্রি করায় তাতে সংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়ে। বিভিন্ন অসাধু ব্যবসায়ীদের হাত দিয়ে সেই বরফই রাস্তায় পানীয় বা আইসক্রিম বিক্রেতাদের কাছে আসে। এই বরফ কোনওমতেই খাওয়ার বরফ নয়।

কি কি ক্ষতি হতে পারে এই বরফে? উৎপলবাবুর কথায়, ঠান্ডা বরফে সুপ্ত অবস্থায় থাকে জীবাণু। কিন্তু মানুষের শরীরে গেলে খুব কম তাপমাত্রাতেই তা সক্রিয় হয়। ই কোলাই, স্যামনেলা টাইফি, লিস্টিরিয়া গোত্রের জলবাহিত বহু জীবাণু ঠিক এ ভাবেই এই বরফের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের শরীরে বাহিত হয়। বমি-আমাশা, আন্ত্রিকের মতো রোগের সম্ভাবনা তো থাকেই, তার সঙ্গে হেপাটাইসিস, কলেরা, টাইফয়েডের মতো বহু রোগ হওয়ার আশঙ্কাও থাকে। অনেক সময়ে জীবাণুর জিনগত পরিবর্তনের ফলে অনেক বড় রোগের সংক্রমণও হতে পারে। রাস্তায় খোলা অবস্থায় বিক্রি হওয়ায় সহজেই হতে পারে সংক্রমণ। সাধারণত বড়দের থেকে ছোটদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি।

তা হলে উপায় কী? ওই বিশেষজ্ঞের কথায়, রাস্তার হকারদের থেকে লেবুর জল, ঠান্ডা পানীয় যতটা সম্ভব বর্জন করা উচিত। বড় দোকানগুলিতে তো বটেই, এমনকী মাঝারি মাপের হোটেল বা রেস্তেরাঁতেও বরফ বানানোর জন্য মেশিন রাখা থাকে। এই সমস্ত মেশিনে সঠিক ভাবে সংক্রমণমুক্ত বরফ তৈরি হয়। এ ছাড়া মিনারেল ওয়াটারে খনিজের মান ঠিক থাকায় তা থেকে বরফে জীবাণু সংক্রমণের আশঙ্কা অনেক কম। তাই অনেক ক্ষেত্রে বেশ কিছু দোকান মিনারেল ওয়াটারই খাওয়ার বরফ তৈরিতে ব্যবহার করে। তাই রাস্তা থেকে খোলা বরফে তৈরি কম দামি আইসক্রিম, লস্যি কিনে না খেয়ে সম্ভব হলে ভাল দোকান থেকেই কিনে খাওয়া উচিত। যে সমস্ত জায়গায় খাদ্য দফতরের সরাসরি নজরদারি রয়েছে এবং আইএসও-র আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে চলে, সেখান থেকে ঠান্ডা পানীয় বা আইসক্রিম কিনে খেলে ক্ষতির আশঙ্কা অনেক কম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন