মারাই গেলেন সিন্ডিকেট নিয়ে গোষ্ঠী সংঘর্ষে জখম তৃণমূল কর্মী সোমনাথ

জীবনের সঙ্গে তিন দিন ধরে পাঞ্জা লড়া শেষ। শনিবার সকালে মারা গেলেন দমদমের মধুগড়ের সেই যুবক সোমনাথ সাধুখাঁ (৩৫)। বিকেলে তাঁর মৃতদেহ এলাকায় পৌঁছলে শোকের আবহের মধ্যেই ক্ষোভ উগরে দিলেন বহু মানুষ। তাঁদের ক্ষোভ শাসক দলের বিরুদ্ধে। পুলিশ সূত্রের খবর, দমদমের মধুগড়ে ইমারতি দ্রব্য সরবরাহের তিনটি সিন্ডিকেট রয়েছে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০১৪ ০২:০৫
Share:

সোমনাথ সাধুখাঁকে শেষ শ্রদ্ধা সৌগত রায়ের। রয়েছেন দক্ষিণ দমদম পুরসভার চেয়ারম্যান পারিষদ প্রবীর পালও (বাঁ দিকে)। —নিজস্ব চিত্র

জীবনের সঙ্গে তিন দিন ধরে পাঞ্জা লড়া শেষ। শনিবার সকালে মারা গেলেন দমদমের মধুগড়ের সেই যুবক সোমনাথ সাধুখাঁ (৩৫)। বিকেলে তাঁর মৃতদেহ এলাকায় পৌঁছলে শোকের আবহের মধ্যেই ক্ষোভ উগরে দিলেন বহু মানুষ। তাঁদের ক্ষোভ শাসক দলের বিরুদ্ধে।

Advertisement

পুলিশ সূত্রের খবর, দমদমের মধুগড়ে ইমারতি দ্রব্য সরবরাহের তিনটি সিন্ডিকেট রয়েছে। অভিযোগ, যে সব গোষ্ঠী সিন্ডিকেট চালায়, তার সব ক’টি দক্ষিণ দমদম পুরসভার চেয়ারম্যান পারিষদ এবং ডাকসাইটে তৃণমূল নেতা প্রবীর পাল ওরফে কেটির মদতপুষ্ট। মৃত সোমনাথ এমনই এক সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গত বুধবার রাতে পিকনিককে কেন্দ্র করে সিন্ডিকেটের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে গোলমাল বাধে। বাঁশ দিয়ে পেটানোর পর ইট দিয়ে থেঁতলে দেওয়া হয় সোমনাথের মাথা। সেই রাতেই তাঁকে বাইপাসের ধারে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সময় যত এগিয়েছে, সোমনাথ শারীরিক অবস্থার তত অবনতি হয়েছে। অবশেষে এ দিন সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করে হাসপাতাল।

এই ঘটনায় তিন জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তবে এ দিন ছেলের মৃতদেহের সামনে বসে সোমনাথের বাবা সন্তোষ সাধুখাঁ অভিযোগ করেন, “গৌরাঙ্গ বারিক ও সাধন ঘোষ আমার বুকের পাঁজর ভেঙে দিল। ওদের শাস্তি চাই।” স্থানীয়রা জানান, গৌরাঙ্গ ও সাধন দু’জনেই সোমনাথদের বিরোধী সিন্ডিকেট গোষ্ঠীর চাঁই। তাঁদের এখনও গ্রেফতার করেনি পুলিশ।

Advertisement

এ দিন বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ মধুগড়ের বাড়িতে সোমনাথের দেহ পৌঁছয়। ছেলের দেহ দেখে কার্যত ভেঙে পড়েন অশীতিপর বাবা। ঠাকুর্দাকে জড়িয়ে ধরে ফ্যালফ্যালে চোখে তাকিয়েছিল সোমনাথের বছর আটেকের ছেলে রোহিত। ছেলের মৃতদেহের সামনে বসে অসহায়ের মতো বাবা বলতে থাকেন, “বলেছিলাম, টাকার জন্য এ সব দলাদলির মধ্যে যাস না। শুনল না।” সন্ধ্যা ছ’টার পরে সোমনাথের দেহ পাড়ার তৃণমূল অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে নিমতলা শ্মশানে যায়। রাতেই অন্ত্যেষ্টি হয়।

বুধবারের ঘটনার পর থেকেই মধুগড়কে কেন্দ্র করে আশপাশের এলাকায় উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। অবস্থা বুঝে শুক্রবারই বিরাট পুলিশ বাহিনী এলাকা টহল দেয়। রাস্তায় নামে ইএফআর জওয়ানরা। এ দিন সকালে সোমনাথের মৃত্যু সংবাদ চাউর হতেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এলাকা। পাল্টা সংঘর্ষের ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন বাসিন্দারা। প্রকাশ্যেই তাঁরা অভিযোগ করতে থাকেন, শাসক দলের নেতাদের মদতে সিন্ডিকেট ব্যবসাকে সামনে রেখে এলাকায় একাধিক গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সেই লড়াইয়ে প্রাণ দিতে হল সোমনাথকে।

সোমনাথের মৃত্যু সংবাদ আসতেই এ দিন সকাল থেকে এলাকায় ছোট ছোট জটলা তৈরি হয়। তার পর বেলা যত গড়িয়েছে, জটলা বেড়েছে। সেই জটলা থেকেই চিৎকার করে কেউ কেউ বলেছেন, একই দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে একটা তরতাজা প্রাণ চলে গেল। সিন্ডিকেটের ব্যবসার ক্ষেত্রে কেন রাজনৈতিক মদত দেওয়া হচ্ছে, তা নিয়ে কেটির বিরুদ্ধেও ক্ষোভ উগরে দেন অনেকে। এক সময় তাঁদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে সোমনাথের বাবাও তৃণমূলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেন। তাঁকে নিরস্ত করতে পাড়ারই কয়েক জন যুবক সন্তোষবাবুকে এক রকম জোর করেই বাড়ির ভিতরে ঢুকিয়ে নিয়ে যায়।

এলাকায় সিন্ডিকেট ব্যবসা নিয়ে যাঁর বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ, সেই প্রবীর পাল ওরফে কেটি এ দিন মৃতদেহের সঙ্গেই সোমনাথের বাড়ির সামনে ছিলেন। ছিলেন দমদমের তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়। তাঁরা কেউই সোমনাথের মা ও স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিতে ভিতরে যাননি। মৃতদেহের সামনে কিছু ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর এলাকা ছাড়েন। সেই সময় সোমনাথের ঘনিষ্ঠ কয়েক জনকে কেটির গলা জড়িয়ে কাঁদতেও দেখা যায়।

সোমনাথের মৃত্যু নিয়ে সৌগতবাবু বলেন, “ছেলেটি আমাদের দল করত। পিকনিক নিয়ে গোলমালের জেরে এই ঘটনা ঘটেছে বলে শুনেছি।” মধুগড়ে না এলেও দমদমের বিধায়ক তথা রাজ্যের পর্যটনমন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেন, “জ্ঞানত, সিন্ডিকেটের কথা জানি না। তবে এই মৃত্যু যদি এমন কোনও ঘটনা সামনে আনে, তা হলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দলীয় নেতৃত্বকে বলব।” কেটি অবশ্য এ দিন কোনও মন্তব্য করতে চাননি।

সাংসদ-বিধায়কেরা যে দাবি-ই করুন, সোমনাথের মৃত্যু এক অজানা আতঙ্ক তৈরি করেছে মধুগড়ে। থমথমে এলাকায় সোমনাথের মৃত্যুর খবর পেয়ে তাঁর ঘনিষ্ঠেরা বিরুদ্ধ পক্ষের লোকজনকে রীতিমতো হুমকি দিতে শুরু করেন। যা শুনে এক বাসিন্দার আশঙ্কা, “আজ হোক বা কাল, এলাকা অশান্ত হবেই।” জটলা থেকে তৃণমূলের কয়েক জনকে বলতে শোনা যায়, “পুরনো লোকদের ভুলে এখন নতুন লোকদের আনছে। এই দল বেশিদিন টিকবে না। সিপিএম-টিএমসি সব এক। আমরা বিজেপি করব।”

পরিস্থিতি যে শান্ত হয়নি, তা আঁচ করেছে পুলিশও। গোলমাল এড়াতে শুক্রবার থেকেই এলাকায় ইএফআর-কমব্যাট ফোর্স মোতায়েন ছিল। এ দিনও সকাল থেকে এলাকায় টহল দিয়েছে তারা। বসানো হয়েছে পুলিশ পিকেট। ব্যারাকপুরের এডিসিপি সুরেশ চাটভি বলেন, “এখনই পুলিশ পিকেট তোলা হচ্ছে না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন