মনে রাখবেন, এখানে কিন্তু কিছুই হয়নি, ভোট শান্তিপূর্ণ

‘আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি মাস্টার মশাই।’ পরিচিত বাংলা ছবির সংলাপে সামান্য হেরফের। আমাদের শুনতে হল, “মনে রাখবেন, এখানে কিন্তু কিছুই হয়নি। যা শুনছেন তা নিয়ে আপনাদের মাথা ঘামাতে হবে না।” তৃণমূলের ব্যাজ আটকে, ঝান্ডা হাতে যাঁরা কথাগুলো বললেন, তাঁরা নিজেদের পরিচয়ও দিয়েছেন। “লিখে নিন, আমার নাম শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী। ব্লক সভাপতি।” অন্য জন বললেন, “আমি সারওয়ার আলি মোল্লা।”

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায় ও সাবেরী প্রামাণিক

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০১৪ ০৩:২২
Share:

শ্যামসুন্দর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে তৃণমূলের মোটরবাইক বাহিনী। বারুইপুরের উত্তর বেলেগাজিতে।

‘আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি মাস্টার মশাই।’ পরিচিত বাংলা ছবির সংলাপে সামান্য হেরফের। আমাদের শুনতে হল, “মনে রাখবেন, এখানে কিন্তু কিছুই হয়নি। যা শুনছেন তা নিয়ে আপনাদের মাথা ঘামাতে হবে না।”

Advertisement

তৃণমূলের ব্যাজ আটকে, ঝান্ডা হাতে যাঁরা কথাগুলো বললেন, তাঁরা নিজেদের পরিচয়ও দিয়েছেন। “লিখে নিন, আমার নাম শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী। ব্লক সভাপতি।” অন্য জন বললেন, “আমি সারওয়ার আলি মোল্লা।”

স্থান বারুইপুরের উত্তর বেলেগাজি। যাদবপুরের ভোট দেখতে দেখতে ১০টা নাগাদ আমরা তখন সোনারপুরের হাসানপুরে। খবর এল বেলেগাজিতে আইসিডিএস কেন্দ্রের বুথে এক দল ভোটারকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। এক জন ভোটারের নাম, ফোন নম্বর জানতে পারলাম। ফোন করতেই তিনি বললেন, “কেন আসছেন? আপনাদের সঙ্গে কথা বললে, ছবি তুললে আমাদের বিপদ হয়ে যাবে।” পৌনে বারোটায় বেলেগাজিতে পৌঁছে তাঁর নম্বর ডায়াল করলাম, ফোন বন্ধ।

Advertisement

গাড়ি থেকে নামতেই সামনে এল ১০-১২ বছরের জনা কয়েক ছেলে। বলে উঠল, “এখানে ভোট পুরো শান্তিপূর্ণ।” পাশে বাড়ির দাওয়ায় শাড়ি শুকোতে দিচ্ছিলেন এক তরুণী। তিনিও একই কথা বললেন। প্রশ্ন ছাড়াই এমন আশ্বাসবাণীতে খটকা লাগল। এগোতেই রেললাইনের উল্টো দিকে জমায়েত। সাদা জামা, চাপ দাড়ি এক প্রৌঢ় স্বঘোষিত ‘গাইড’ হয়ে আমাদের নিয়ে স্থানীয় প্রাথমিক স্কুলের দিকে এগোতে লাগলেন। প্রশ্ন ছাড়াই তাঁরও মন্তব্য, “এত শান্তিপূর্ণ ভোট আগে এখানে হয়নি। সিপিএম তো কুৎসা রটাবেই।”

প্রাথমিক স্কুলের সেই বুথে দু’-এক জন পুলিশ ছিল, কিন্তু কেন্দ্রীয় বাহিনী নেই। আমাদের ‘গাইড’ বাবর আলি সর্দার ঢুকে পড়লেন বুথের ভিতরে। কেউ আটকাল না। আপনি ভোট দেননি? বাবরের জবাব, “আমি সকাল-সকাল ভোট দিয়েছি। এলাকার ক’জনের শরীর খারাপ, তাই ভোট দেওয়াতে নিয়ে এসেছি।”

ভোট দিয়ে এসে বাড়িতে কফি খাচ্ছেন সুগত বসু।

বুথের বাইরে কয়েক জন নিচু স্বরে বলার চেষ্টা করছিলেন, ভোট দিতে গিয়ে অনেকেই বাধা পাচ্ছেন। তাঁদের থামিয়ে বাবর বললেন, “এখানে ইভিএম খারাপ ছিল বলে ভোট কিছু ক্ষণ বন্ধ ছিল।” বুথের ভিতরে ভোটকর্মী বা পুলিশ কিন্তু জানিয়েছে, এমন কোনও ঘটনা তখনও ঘটেনি।

তবে কি আইসিডিএস কেন্দ্রের বুথে গোলমাল হয়েছে? মুহূর্তে বদলে গেল ‘বিনয়ী’ বাবরের স্বর। তখনই শুনতে হল ‘‘এখানে কিন্তু কিছুই হয়নি।’’ তাকিয়ে দেখি রেললাইনের উল্টো দিকের জটলাটা বড় হচ্ছে। বাবর বললেন, “চলুন, আমাদের ব্লক সভাপতির সঙ্গে কথা বলবেন।”

লাইন পেরোতেই জটলাটা আমাদের ঘিরে ধরল। ব্লক সভাপতি শ্যামসুন্দরবাবু আমাদের পরিচয় জেনে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ভিড়ের ভেতরে কেউ বললেন, “খবরটা এখানকারই কেউ দিয়েছে। না হলে এরা এত দূর এল কী ভাবে?”

আমাদের ঘিরে তখন প্রবল চিৎকার। ব্লক সভাপতি নিজের পরিচয় জানিয়ে বলছেন, “কী লিখবেন? সন্ত্রাসের আবহে ভোট চলছে?” ভিড়টা তত ক্ষণে প্রায় গায়ে উঠে এসেছে। বললাম, “আপনাকে তো কিছু জিজ্ঞাসা করিনি।” তাতে গলার স্বর আরও চড়ল। সঙ্গে সংবাদপত্রের প্রতি বিষোদ্গার। ভেসে আসছে টুকরো মন্তব্য, ‘‘এদের ছাড়া যাবে না। উচিত শিক্ষা দিতে হবে।’’ বললাম, ‘‘রাস্তা ছাড়ুন।’’ মুখগুলো আরও এগিয়ে এসে বলল, “আপনাদের তো কেউ আটকে রাখেনি।” চারপাশে তাকিয়ে বুঝলাম চক্রব্যূহে আটকে পড়েছি।

গ্রামের রাস্তায় গাড়ি ঢোকে না। আমাদের গাড়ি অনেকটা দূরে। হেঁটে বেশি দূর ফিরতেও পারব না। আমাদের রোখা যাবে না বুঝে ভিড় কিছুটা পাতলা হল। এগোতেই বুঝলাম ক’জন পিছু নিয়েছেন। রয়েছে ভিড়ে দেখা কয়েকটা মুখও। কিছু বাসিন্দার সঙ্গে কথা শুরু করতেই সেই মুখগুলো ফের আমাদের ঘিরে ধরল। বলল, “আরও মিনিট কুড়ি হাঁটলে আইসিডিএস কেন্দ্রের ওই বুথটা পাবেন। চলুন, আমরাই নিয়ে যাচ্ছি।” বিপদের গন্ধ পেয়ে স্থির করলাম, আর এগোব না। কিন্তু ফিরতি পথ ধরতেই রক্ত হিম হয়ে গেল। দেখলাম সরু রাস্তা ধরে ঝড়ের গতিতে এগিয়ে আসছে মোটরবাইক বাহিনী। এক-একটা মোটরবাইকে দু-তিন জন। আছেন ব্লক সভাপতি শ্যামসুন্দরবাবুও। আমাদের ঘিরে মোটরবাইক আরোহীরা জিজ্ঞাসা করলেন, “যাবেন না? আমরা তো আপনাদের নিতেই এলাম।” বললাম, “আমাদের সহকর্মীরা আসছেন। তাঁরা এলে যাব।” শ্যামসুন্দরবাবু বললেন, “চলুন না, দেখে আসবেন।” ভিড়ের মুখগুলো তখন আপাদমস্তক মাপছে আমাদের। অনেকেই বলছেন, “এদের খাতির-যত্নের ব্যবস্থা করতে হবে।” বাকিরা হেসে উঠছেন। এরই মধ্যে ক’জন এসে শ্যামসুন্দরবাবুকে বললেন, “এদের ছেড়ে দিন, ঝামেলা বাড়াবেন না।” তাঁদেরও বুকে তৃণমূলের ব্যাজ। আমাদের ছাড়া হবে কি না, তা নিয়ে নিজেদের মধ্যেই শুরু হল বাগ্বিতণ্ডা, ধাক্কাধাক্কিও। ভাগ্যিস! কারণ সেই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়েই দ্রুত ফিরতে শুরু করলাম গাড়ির দিকে। তখনও ভেসে আসছে মন্তব্য, “সব ক’টা সিপিএমের দালাল। চা-জল না খাইয়ে এদের ছাড়া ঠিক হল না।”

কিছু দূর এগোতে ফুলতলা, রামকৃষ্ণ পল্লির একটি বুথে ঢোকার মুখেও প্রতিরোধ। “এখানে আসার কী দরকার? এখানে সব শান্তিপূর্ণ।” একই অভিজ্ঞতা সোনারপুরের একাধিক বুথে। বিকেলেও নানা জায়গা থেকে বুথ জ্যাম, ভোটারদের আটকানো, কোথাও বা এজেন্ট অপহরণের খবর আসছে। দিনভর যাদবপুরে যখন এমন নানা ঘটনা ঘটেছে, তৃণমূল প্রার্থী সুগত বসু তখন তাঁর দক্ষিণ কলকাতার শরৎ বসু রোডের বাড়িতেই বিশ্রাম নিচ্ছেন। সকালে ভোট দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে মা কৃষ্ণা বসুর সঙ্গে কফি খেতে খেতে তিনি বলছিলেন, “বেলার দিকে বেরিয়ে দলের কিছু কর্মীকে ধন্যবাদ জানাব।” আর সিপিএমের কর্মীরা যখন নানা জায়গায় হেনস্থার অভিযোগ তুলে হন্যে হয়ে সুজন চক্রবর্তীকে খুঁজছেন, তিনি তখন ভাঙড়ে আরাবুল ইসলামের ‘মেশিনারি’র মোকাবিলায় ব্যস্ত। তাঁর কথায়, “পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূল তো ভাঙড় লুঠ করেছিল। তাই এ বারে ও দিকে মন দিয়েছিলাম। এখানে থেকেই বা কী করতে পারতাম?”

ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন