রবিতীর্থের পুণ্যার্থী সেই মেয়ে

১৯৪৫ সালে বেরোয় তাঁর প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড। বাকিটা ইতিহাস। ঘরোয়া ‘গজু’ থেকে আন্তর্জাতিক সুচিত্রা মিত্র হয়ে ওঠার ইতিহাস। লিখছেন উজ্জ্বল চক্রবর্তীবাইশে শ্রাবণ। ঝাপসা চোখে কলেজ স্ট্রিটের একটি বাড়ির উপর থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষযাত্রা দেখছে বছর সতেরোর যে তরুণী, সম্প্রতি সে শান্তিনিকেতন যাওয়ার ছাড়পত্র পেয়েছে। কিন্তু যাঁর ভরসায় ভুবনডাঙার মাঠ পেরোনোর স্বপ্ন দেখা শুরু, আশি বছরের সেই যুবকটিই তো জনস্রোতে বয়ে যাচ্ছেন নীচ দিয়ে! অন্তিম পথের উদ্দেশে। তবে আর যাওয়া কেন বৃথা। লিখছেন উজ্জ্বল চক্রবর্তী

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৪ ০০:০০
Share:

একসঙ্গে তিন বোন সুজাতা, সুপ্রিয়া এবং সুচিত্রা।

বাইশে শ্রাবণ। ঝাপসা চোখে কলেজ স্ট্রিটের একটি বাড়ির উপর থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষযাত্রা দেখছে বছর সতেরোর যে তরুণী, সম্প্রতি সে শান্তিনিকেতন যাওয়ার ছাড়পত্র পেয়েছে। কিন্তু যাঁর ভরসায় ভুবনডাঙার মাঠ পেরোনোর স্বপ্ন দেখা শুরু, আশি বছরের সেই যুবকটিই তো জনস্রোতে বয়ে যাচ্ছেন নীচ দিয়ে! অন্তিম পথের উদ্দেশে। তবে আর যাওয়া কেন বৃথা। কিন্তু সঙ্গীতভবনে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি যে শেষ। স্রষ্টার মৃত্যুতে আপাত ভাবে না-যাওয়ার ভাবনা এলেও শেষমেশ সিদ্ধান্ত বহাল থাকে। এরই কুড়ি দিন পর এক বৃষ্টির দিনে বাবার সঙ্গে বোলপুর পৌঁছবে ওই তরুণী। ১৯৪১-এর সে দিন থেকেই শান্তিনিকেতন হয়ে উঠবে তার যৌবনের রূপকথার রাজ্য। এর বছর চারেক পর বেরোয় ওই তরুণীর প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড। বাকিটা ইতিহাস। ঘরোয়া ‘গজু’ থেকে আন্তর্জাতিক সুচিত্রা মিত্র হয়ে ওঠার ইতিহাস।

Advertisement

মেয়ের নাম গজু। এর উৎস সন্ধানে যেতে গেলে পৌঁছতে হবে ঝাড়খণ্ডের একটি স্টেশনে, গুজন্ডি। ১৯২৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর যদিও ঝাড়খণ্ডের কোনও অস্তিত্ব ছিল না। তখন সে বিহারের অধীন। দেহরি অন-সোন-এর দিক থেকে আসা একটি ট্রেন হঠাৎই থেমে গেল শালবন ঘেরা এই স্টেশনে। থামার কোনও কথা ছিল না। কিন্তু আগের স্টেশনের স্টেশনমাস্টার জরুরি খবর পাঠিয়েছেন, ট্রেনের ভেতর অসুস্থ এক মহিলার এখনই চিকিৎসার প্রয়োজন। ডাক্তারের ব্যবস্থা করে পৌঁছনো গেল অসুস্থ সেই মহিলার কাছে। অন্তঃসত্বা মহিলা ট্রেনের ভিতরেই জন্ম দিলেন এক কন্যাসন্তানের। গুজন্ডিতে জন্ম বলে মেয়ের নাম রাখা হল গজু। কিন্তু ওই স্টেশনমাস্টার অসুস্থতার খবর পেলেন কী ভাবে? স্ত্রী, পুত্র এবং দুই কন্যাকে নিয়ে দেহরি অন-সোন থেকে ফিরছিলেন সদ্যোজাত কন্যার বাবা সৌরিন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়। পথেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তাঁর স্ত্রী সুবর্ণলতা দেবী। কিন্তু ট্রেন তো মাঝপথে থামবে না। চেন টানার ব্যবস্থাও নেই। পুত্রের কোটের পকেটে রাখা খেলার সঙ্গী শিশি-নুড়ি পাথরই ‘মেসেঞ্জার’ হয়ে উঠল শেষে। সাদা কাগজে ‘আমার স্ত্রী খুবই অসুস্থ, দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন’ লিখে তাকে শিশি-বন্দি করে ট্রেন থেকে ছুড়ে দেওয়া গেল অচেনা-অজানা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। ভ্যগ্যিস সেই শিশি-চিঠি স্টেশনমাস্টারের হাতে পৌঁছয়। তা না হলে কি আর গুজন্ডিতে থামত ট্রেন! না কি মেয়ের নাম গজু রাখা যেত। তাঁর ‘সুচিত্রা মাসি’র কাছে বহু বার শোনা এ গল্প এখনও মনে করতে পারেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী প্রমিতা মল্লিক।

সুচিত্রা মিত্রের সঙ্গে প্রমিতা মল্লিক।

Advertisement

সৌরিন্দ্রমোহন ছিলেন পেশায় পুলিশ কোর্টের আইনজীবী। কিন্তু নেশা ছিল তাঁর সাহিত্য। ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত ‘ভারতী’ পত্রিকাও যুগ্ম ভাবে সম্পাদনা করেছেন বেশ কয়েক বছর। সেই পরিবারে যে সংস্কৃতি জগতের কৃতীদের আনাগোনা থাকবে, তাতে আর আশ্চর্য কী! সেই সুবাদে আসতেন সৌরিন্দ্র-বন্ধু পঙ্কজকুমার মল্লিক। দাদা-দিদিদের মতো সুচিত্রারও গান-ছবি-লেখালেখি-অভিনয় সবেতেই উৎসাহ। এ সব দেখে সুচিত্রাকে গান শেখানো শুরু করেন পঙ্কজকুমার। মূলত তাঁরই আগ্রহে গজুর শান্তিনিকেতন যাত্রা। বেথুনে তখন সে দশম শ্রেণির ছাত্রী। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে বিশ্বভারতীতে সঙ্গীতশিক্ষার বৃত্তি পরীক্ষার জন্য আবেদন করল। পেয়েও গেল। ২০ টাকা বৃত্তি মিললেও সেখানে পড়ার খরচ বাবদ বাকি সাত টাকা এবং হাতখরচের তিন টাকার ব্যবস্থা করেছিল তার দুই দিদি। কাজেই ম্যাট্রিক আর দেওয়া হল না। পরে ১৯৪৩ সালে প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পাশ করে স্কটিশ চার্চ কলেজে বাংলা নিয়ে আইএ ভর্তি হয় সে দিনের তরুণী সুচিত্রা। আরও পরে বিএ এবং এমএ পাশ করেন তিনি।

শান্তিনিকেতন যাওয়ার আগেই মুখোপাধ্যায় পরিবারে তৈরি হয়েছিল ‘ডাস্ট অ্যান্ড স্টার হাসলারস’ নামের একটি সংগঠন। বাড়ির ছাদে অভিনীত হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চিত্রাঙ্গদা’। ১৫ বছরের গজু দাদা-দিদিদের সঙ্গে সেই গান-অভিনয়ে অংশ নেয়। মিত্র ইনস্টিটিউশন-এও এই নৃত্যনাট্য অভিনীত হয়। সেখানে গানে অংশ নিয়েছিলেন তার দিদির বন্ধু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সঙ্গীত ভবনে গিয়ে তরুণী সুচিত্রা শিক্ষক হিসেবে পেলেন শৈলজানন্দ মজুমদার ও ভিভি ওয়াঝলওয়াড়কে। পেলেন ইন্দিরা দেবীকে। তবে শান্তিদেব ঘোষকে সঙ্গীতগুরু হিসেবে মেনে নিলেন তিনি। শিখলেন এস্রাজ ও তবলা। ১৯৪৫ সালে কলকাতায় ফিরে এইচএমভি থেকে প্রথম রেকর্ড বেরলো সুচিত্রার। দু’পিঠে দুটো গান ‘হৃদয়ের একূল ওকূল দুকূল ভেসে যায়’ এবং ‘মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান’। দু’টিই শিখিয়েছিলেন তাঁর ‘বিবিদি’ মানে ইন্দিরা দেবী। এই সময় তাঁকে লন্ডনের ‘টেগোর হিম সোসাইটি’ পুরস্কৃত করে। এর পরের প্রায় পাঁচ দশক বাঙালি পেয়েছে তাঁর গান সমৃদ্ধ অগণিত ডিস্ক। রবীন্দ্রনাথের গানের পাশাপাশি অতুলপ্রসাদের গান, ব্রহ্মসঙ্গীত, আধুনিক বাংলা গান বা হিন্দি ভজনও গেয়েছেন সুচিত্রা।

গণনাট্য আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন শান্তিনিকেতন ফেরত সুচিত্রা। অনুষ্ঠান করতে থাকেন একের পর এক। পরিচিতি বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে খ্যাতিও। ১৯৪৬ সালে দ্বিজেন চৌধুরীর সহযোগিতায় সুচিত্রা প্রতিষ্ঠা করেন ‘রবিতীর্থ’। রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রসারে আজীবন তিনি এই সঙ্গীত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবেও তিনি ছাত্রছাত্রীদের অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। তাঁর শিক্ষক সত্তা নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্না চেপে রাখতে পারলেন না রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী পূর্বা দাম। বললেন, “সুচিত্রাদি যে ভাবে শিখিয়েছেন তা ভুলতে পারিনি। এখনও সেই ভাবেই গাওয়ার চেষ্টা করি।” এ সবের মধ্যেই রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন সুচিত্রা মিত্র। সেটা ১৯৬৩ সাল। পরে অধ্যাপক পদের পাশাপাশি সঙ্গীত বিভাগের প্রধানও হয়েছিলেন তিনি। ১৯৮৪ সালে শিক্ষকতা থেকে অবসর নেন। সারা জীবনে পুরস্কার পাওয়ার তালিকাও কিন্তু কম নয়। পদ্মশ্রী থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি লিট খেতাব— সবেতেই তাঁকে সম্মানিত করা হয়।

সে দিন মে দিবস। ১৯৪৮ সাল। গণনাট্যেরই সদস্য ধ্রুব মিত্রকে বিয়ে করলেন সুচিত্রা। তবে বছর সাতেকের মধ্যেই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভেঙে গেল। ‘ব্যক্তিত্বের মিলমিশ’ না হওয়াই কারণ। তবে তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা ছিন্ন হয়নি। ১৯৫০ সালে জন্মায় ধ্রুব-সুচিত্রার ছেলে কুণাল। ভাইয়ের মেয়ে সুদেষ্ণাকেও তিনি আপনহাতে মানুষ করেছেন। এ দু’জনের মতোই একই স্নেহ পেয়েছে রবিতীর্থের অসংখ্য ছাত্রছাত্রী।

শেষের কয়েক বছর ভীষণই অসুস্থ ছিলেন সুচিত্রা মিত্র। বাড়ি থেকে বেরোতেন না। ভাল করে কথাও বলতে পারতেন না। অনুজ শিল্পী বা ছাত্রছাত্রীরা বাড়িতে দেখা করতে গেলে খুশি হতেন। ২০১১ সালের ৩ জানুয়ারি দুপুরবেলা দক্ষিণ কলকাতার ফ্ল্যাটে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় ৮৬ বছরের যশস্বী এই শিল্পীর।

—ফাইল চিত্র।

শ্রদ্ধার্ঘ্য...

প্রমিতা মল্লিক

দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়

পূর্বা দাম

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন