লজ‌্‌ঝড়ে গাড়ি ঠেলতে বন্দিরাও ভরসা পুলিশের

থানার গাড়ি নিয়ে মাঝরাতে দুষ্কৃতী ধরতে গিয়েছিলেন কয়েক জন পুলিশ অফিসার। হানা দিয়ে জনা চারেক যুবককে পাকড়াও করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু থানার উদ্দেশে রওনা দিতেই মাঝপথে গাড়ি গেল বিগড়ে। হাজারো চেষ্টাতেও তার নড়ন-চড়ন নেই।

Advertisement

মেহবুব কাদের চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৫ ০০:৫৩
Share:

অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

থানার গাড়ি নিয়ে মাঝরাতে দুষ্কৃতী ধরতে গিয়েছিলেন কয়েক জন পুলিশ অফিসার। হানা দিয়ে জনা চারেক যুবককে পাকড়াও করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু থানার উদ্দেশে রওনা দিতেই মাঝপথে গাড়ি গেল বিগড়ে। হাজারো চেষ্টাতেও তার নড়ন-চড়ন নেই। শেষমেশ কোমরে দড়ি বাঁধা আসামিদের দিয়েই ঠেলাতে হল গাড়ি!

Advertisement

ওই গাড়িতে থাকা এক পুলিশকর্মী বলছেন, ‘‘গাড়ির যা অবস্থা, তাতে মাঝেমধ্যেই ঠেলতে হয়। বেশির ভাগ সময়ে আমরাই ঠেলি। সে বার লোক কম থাকায় নিরুপায় হয়ে আসামিদের কাজে লাগাতে হয়েছিল।’’ এবং কলকাতা পুলিশের অধিকাংশ অফিসারেরই অভিযোগ, থানায় গাড়ির যা হাল, তাতে এমন ঘটনা বিরল নয়।

২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদলের পরে কলকাতা পুলিশের আওতাধীন এলাকার আয়তন বেড়েছে। তৈরি হয়েছে নতুন-নতুন থানা। কিন্তু থানায় গাড়ির সংখ্যা তেমন বাড়েনি। উল্টে যে সব গাড়ি রয়েছে, সেগুলিরও বেহাল দশা। উত্তর কলকাতার একটি থানার ওসি বলছেন, ‘‘থানায় আমার ও অতিরিক্ত ওসির গাড়ি বাদ দিয়ে একটি বড় ভ্যান আছে। এ দিকে গলির মধ্যে কোনও ঘটনা ঘটলে বড় গাড়ি ঢুকতে পারে না।’’ বাধ্য হয়ে পাড়ার কয়েক জন অটোচালককে বলে রেখেছেন ওই ওসি। কোনও অপরাধের খবর এলে অটোয় চেপেই যাতায়াত করেন ওই থানার কর্মী-অফিসারেরা।

Advertisement

কলকাতা পুলিশে দীর্ঘ দিন কাজ করা অফিসারেরা বলছেন, থানায় ওসি ও অতিরিক্ত ওসির গাড়ি (বেশির ভাগ ক্ষেত্রে টাটা সুমোর মতো গাড়ি) ছাড়া অন্তত দু’টি বড় পুলিশ ভ্যান থাকা দরকার। পাশাপাশি জিপ জাতীয় গাড়ি না থাকলে গলি, তস্য গলিতে নজরদারি চালানো সম্ভব নয়। প্রয়োজন মোটরবাইকও। কিন্তু কলকাতা পুলিশের বেশির ভাগ থানাতেই মোটরবাইক থাকলেও জিপ জাতীয় গাড়ি নেই। বড় পুলিশ ভ্যানও একটির বেশি থাকে না। মধ্য কলকাতার একটি থানার এক এসআই বলছেন, ‘‘হয়তো ছোটখাটো বিবাদের ঘটনা। দু’জন সিপাইকে নিয়ে ঘটনাস্থলে যেতে হলেও বড় ভ্যানে চাপতে হয়।’’ লালবাজার সূত্রের খবর, বন্দর বিভাগের একটি থানার পুলিশ ভ্যান দশ দিন ধরে গ্যারাজে। কাজ চালাতে বিকল্প গাড়ি দেওয়া হয়েছে। তা-ও সমস্যা মেটেনি।

থানার ওসি বা অতিরিক্ত ওসি-দের যে সব গাড়ি রয়েছে, তা নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে অফিসারদের। যাদবপুর ডিভিশনের একটি থানার অতিরিক্ত ওসির গাড়ি কিছু দূর চললেই ধোঁয়া বেরোতে শুরু করে। উত্তর কলকাতার এক অতিরিক্ত ওসি-র কপালে জুটেছে ভাঙাচোরা একটি জিপ! দক্ষিণ কলকাতার এক থানার অতিরিক্ত ওসি-র আক্ষেপ, ‘‘আমার গাড়ির বয়স আর আমার বয়স বোধহয় সমান!’’

বিভিন্ন থানার অফিসারেরা বলছেন, গাড়ির অভাব থাকায় বহু সময়েই ওসি বা অতিরিক্ত ওসি-র গাড়ি তুলনায় বেশি ঘোরে। তা ছাড়া, নিজেদের এলাকায় টহলদারি তো থাকেই। ‘‘এত বেশি রাস্তা চলার ফলে দু’-তিন বছর পেরোলেই গাড়িগুলিতে সমস্যা হতে শুরু করে। বারবার খারাপ হয়,’’ বলছেন এক ওসি। পুলিশের অনেকেই বলছেন, পুরনো গাড়ির বাইরেটা রং করে চালানো হচ্ছে। ভিতরের যন্ত্রপাতি তো নতুন হচ্ছে না। ফলে পুলিশের গাড়ি থেকে দূষণের অভিযোগও উড়িয়ে দিতে পারছেন না অফিসারেরা। এক পুলিশকর্তার কথায়, ‘‘আমাদের বহু গাড়িই পুরনো। ওই ধরনের ইঞ্জিন থাকলে কলকাতায় রেজিস্ট্রেশন মেলে না। তাই বর্ধমান থেকে রেজিস্ট্রেশন করানো হয়েছে।’’

লালবাজারের একাধিক সূত্র বলছে, ১৯৯৬ সালের আগে শহরের সব থানার বিকল গাড়ি এক জায়গায় সারানো হতো। ১৯৯৬ সালের পরে আটটি ডিভিশন ভিত্তিক এলাকায় মোটর ট্রান্সপোর্ট অফিস চালু হয়েছে। ‘‘ডিভিশন ভিত্তিক মোটর ট্রান্সপোর্ট অফিস চালু করেও কাজের কাজ হয়নি। থানার গাড়ি খারাপ হলে সেখানে দিতে গিয়েও লাল ফিতের ফাঁসে গাড়ি সারাতে বহু সময় লেগে যায়,’’ বলছেন এক ইনস্পেক্টর। সময় বাঁচাতে বাধ্য হয়ে স্থানীয় গ্যারাজে দিয়ে ছোটখাটো সমস্যা ঠেকাতে হয়।

এই পরিস্থিতির বদল হবে বলে অবশ্য আশ্বাস দিচ্ছেন কলকাতা পুলিশের কর্তারা। যুগ্ম কমিশনার (প্রশাসন) মেহবুব রহমান বলেন, ‘‘তিন বছর আগের তুলনায় থানায় অনেক নতুন গাড়ি আনা হয়েছে। শহরের থানার পুরনো পুলিশ ভ্যানগুলি ধীরে ধীরে সরিয়ে দেওয়া হবে। আনা হবে ছোটগাড়়িও।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন