জনাদেশ ’১৪

সবুজের অভিযানে পদ্ম-কাঁটার খোঁচাও

ভবানীপুরে কলকাতা দক্ষিণের তৃণমূল প্রার্থীর ভোট-অফিসের সামনে তখন চুটিয়ে সবুজ আবিরের খেলা চলছে। সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে জনৈক প্রৌঢ় ছুড়ে দিলেন ফিচেল মন্তব্য: ‘‘আগে কিছু তরমুজ দেখা যেত এখানে। এ বার কিছু আমও উঠেছে!” ‘ভিতরে লাল, বাইরে সবুজ’ তরমুজের উপমাটা পুরনো কিছু রাজনৈতিক তরজার সৌজন্যে এ বঙ্গে বহুল পরিচিত।

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৪ ০২:৩২
Share:

ফুলের বাজারে পদ্মের পসরা। শুক্রবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী।

ভবানীপুরে কলকাতা দক্ষিণের তৃণমূল প্রার্থীর ভোট-অফিসের সামনে তখন চুটিয়ে সবুজ আবিরের খেলা চলছে। সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে জনৈক প্রৌঢ় ছুড়ে দিলেন ফিচেল মন্তব্য: ‘‘আগে কিছু তরমুজ দেখা যেত এখানে। এ বার কিছু আমও উঠেছে!”

Advertisement

‘ভিতরে লাল, বাইরে সবুজ’ তরমুজের উপমাটা পুরনো কিছু রাজনৈতিক তরজার সৌজন্যে এ বঙ্গে বহুল পরিচিত। এ বার তার সঙ্গে আমের উপমাও যোগ হল। তৃণমূল-সমর্থক ওই প্রৌঢ়ই ব্যাখ্যা করলেন, আম মানে বাইরেটা সবুজ, ভিতরে কমলা যা অনেকটাই মিলে যাচ্ছে তৃণমূল ও বিজেপি-র রঙের সঙ্গে। কথাটা যে খুব ভুল নয়, তা মালুম হল একটু বাদেই। যুদ্ধে হেরে দুপুর-দুপুর বাড়ি ফিরে বিজেপি প্রার্থী তথাগত রায় যখন মুচকি হেসে বলবেন, “আমার কিন্তু একটা সান্ত্বনা-পুরস্কার আছে! ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রে আমি কয়েকশো ভোটের লিড পেয়েছি!” ভবানীপুর মানে খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিধানসভা কেন্দ্রে পদ্মফুল ফোটা একটি নমুনা! চুপচাপ পদ্মে ছাপ দেওয়া ভোটারদের কল্যাণে শহর কলকাতায় বিজেপি-ই তৃণমূলের পরে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। ভবানীপুরের ৭২ নম্বর ওয়ার্ডে শহরের অন্যতম পুরনো তৃণমূল পার্টি অফিসের সামনে কর্মী-সমর্থকদের জটলাতেও দলীয় সভাপতি সুব্রত বক্সীর মার্জিন কমার মৃদু হা-হুতাশ শোনা যাচ্ছিল। শুক্রবার রাজ্য জুড়ে শাসক দলের বিপুল আসন জয়ের উদ্যাপনেও তলে তলে এ ভাবেই পদ্ম-কাঁটা বিঁধে রইল।

জয়োল্লাস: উন্মাদনা। ভোটের ফল প্রকাশের পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাড়ায়। শুক্রবার। ছবি: সুদীপ আচার্য।

Advertisement

বেলা সাড়ে ১০টা। জয়-পরাজয়ের ছবিটা তখনও স্পষ্ট হয়নি। কিন্তু সাত-সকালে অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস ধরে জগন্নাথঘাটের ফুলবাজারে হাজির আসানসোলের চন্দ্রশেখর মালাকার। “আমি জানি, বাবুল সুপ্রিয় জিতবে” বলে বুড়ো বাগদী, উত্তম খানদের কাছ থেকে ৫০০ পদ্মফুল বাছাই করলেন। রাশি-রাশি গাঁদার মালা, পদ্মের ঝাঁকি মাথায় তুলে বেচারি মুটের হিমশিম দশা! ফুলবাজারের একটি আড়তের মালিক বাপি চক্রবর্তীও আফশোস করছিলেন, দিল্লিতে পদ্মের জয়জয়কারে বাঁকুড়া, বর্ধমান থেকে পদ্মের আরও কিছু স্টক এনে রাখলে মন্দ হতো না!

দুপুরের দিকে দেখা গেল, লেক মার্কেটেও পদ্মই আব্দুল লতিফের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। সাধারণত পদ্ম রাখেন না। কিন্তু এ দিন পদ্ম কিছু একটা ঘটাতে পারে ভেবেই বুদ্ধি করে কিছু এনে রেখেছিলেন। হেসে বললেন, “পাঁচটা, আটটা, বারোটা করে লোকে সব নিয়ে গেল! হয়তো ভাল করে ফুটিয়ে কারও হাতে দেবে। ঘর ঘর মোদীর ব্যাপার!”

পদ্মপুকুর রোডে শতাব্দী-প্রাচীন মিষ্টির দোকানের মালিক সুদীপ মল্লিকের পরিশ্রমও এ দিন সার্থক হয়েছে। নতুনবাজারে বসে থেকে এক দিন আগে দেশের হবু প্রধানমন্ত্রীর মুখের কাঠের ছাঁচ গড়িয়েছিলেন। সেই ছাঁচে নিপুণ ভাবে নরেন্দ্র মোদীর মুখ ফুটিয়ে আড়াইশো গ্রাম ওজনের পেল্লায় সন্দেশ হয়েছে। দুপুর বারোটা নাগাদ কোনও আগাম ঘোষণা ছাড়াই ‘প্রাইম মিনিস্টার’ সন্দেশ আত্মপ্রকাশ করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ট্রে খালি করে সব হাতে হাতে উড়ে গেল।

মোদীর জয়ে দিল্লি, আমদাবাদ, বারাণসীর মতো উত্তাল জয়োল্লাস কলকাতায় দেখা যায়নি। ভোটের ফলে এ রাজ্যে তৃণমূলের একচ্ছত্র দাপটের পটভূমিতে তা দেখার কথাও হয়তো নয়। তবু এ শহরের ভোট-পরবর্তী উৎসবে বিজেপি-র অস্তিত্ব খানিকটা হলেও মালুম হয়েছে। ‘হয় দু’টি নয়তো একটি ফুল’ বিজ্ঞাপনী প্রচার থেকে ধার করা সংলাপ মুখে মুখে ফিরেছে। গণনার দিনে বিজেপি অফিসের সামনে জোরদার পুলিশ-পাহারা।

এমনিতে শরৎ বসু রোড, কালীঘাট, হাজরা, শ্যামবাজার, বড়বাজার, বেলেঘাটা সর্বত্রই দেখা মিলেছে সবুজ আবির মাখা বাইক-আরোহীদের। গাড়িতে জোড়া ফুলছাপ পতাকা বেঁধে পাগলের মতো চরকিপাক খাচ্ছেন। পাড়ায় পাড়ায় টিভি-র জায়ান্ট স্ক্রিনের সামনে ভোটের রেজাল্ট লাইভ দেখার ব্যবস্থা হয়েছিল শাসক দলের কিছু পার্টি অফিসে। ১২টা বাজার আগেই সেখান থেকে ছোট-বড় মিছিল বেরোতে শুরু করে।

তবে ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে জয়ের সঙ্গে তুলনায় এই উল্লাস খানিকটা নিচু তারে বাঁধা। কলকাতা উত্তরের জয়ী প্রার্থী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী নয়না বন্দ্যোপাধ্যায় সাধারণত স্বামী জয়ের সার্টিফিকেট পাওয়া পর্যন্ত বাড়িতে একা বসে থাকেন। সন্ধ্যা পুইয়ে সুদীপ বাড়ি ফিরতে পরের দিন উৎসবের পরিকল্পনা করতে বসলেন। কালীঘাট ব্রিজের কাছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির গলির সামনে কয়েক জন দিদি-ভক্ত লাড্ডু-কোল্ড ড্রিঙ্কে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন।

প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের শপিং মলের জায়ান্ট স্ক্রিনেও এ দিন শুধুই চ্যানেলের ভোট-ফলের ধারাবিবরণী। এর মধ্যেই তৃণমূল-ভক্তদের উচ্ছ্বাসে রাজ্যে কংগ্রেস ও বামপন্থীদের দুরমুশ করার তৃপ্তি বেরিয়ে আসছিল। যাদবপুরের দম্পতি গৌতম ও পাপিয়া আইচ শপিং মলে কেনাকাটা করার ফাঁকেই স্ক্রিনের সামনে দাঁড়ালেন। গৌতমবাবু বলছিলেন, “জানতাম, তৃণমূল অন্তত ৩০টা পাবেই পাবে!” হাতিবাগানের এক তৃণমূল নেতার কথায় কিন্তু ঘোর বিস্ময়: “একটা পোস্টার, দেওয়াল-লিখন নেই, তবু বিজেপি সেকেন্ড। ভাবা যাচ্ছে না!”

ভোটের শহরের এই রংবেরঙের দৃশ্যে শুধু লালের ছিটেফোঁটাও কোত্থাও খুঁজে পাওয়া গেল না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন