হামলায় আক্রান্তের তালিকায় অফিসারেরাও, উদ্বিগ্ন লালবাজার

খাস কলকাতা শহরের বুকে একের পর এক পুলিশকর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের মনোভাব নিয়ে চিন্তিত লালবাজারের শীর্ষকর্তারা। এত দিন দুষ্কৃতীদের হাতে সাধারণ পুলিশকর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটছিল শহরের বিভিন্ন এলাকায়।

Advertisement

শিবাজী দে সরকার

শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০২
Share:

খাস কলকাতা শহরের বুকে একের পর এক পুলিশকর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের মনোভাব নিয়ে চিন্তিত লালবাজারের শীর্ষকর্তারা।

Advertisement

এত দিন দুষ্কৃতীদের হাতে সাধারণ পুলিশকর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটছিল শহরের বিভিন্ন এলাকায়। কিন্তু বুধবার রাতে খিদিরপুরের ফ্যান্সি মার্কেটের সামনে অভিযুক্ত এক জনকে ধরতে গিয়ে দুষ্কতীদের হাতে আক্রান্ত হতে হয়েছে দুষ্কৃতী মোকাবিলায় সবচেয়ে পরিচিত গোয়েন্দা বিভাগের গুন্ডাদমন শাখারই তিন অফিসারকে। ভাঙচুর হয়েছে পুলিশের দু’টি গাড়িতেও।

সন্ধ্যায় খিদিরপুরের মতো এলাকায় আক্রান্ত পুলিশ অফিসারদের সাহায্যে স্থানীয় থানার পুলিশ ঠিক সময়ে না পৌঁছলে কী হত, তা নিয়েই চিন্তিত লালবাজারের কর্তারা। এক কর্তার বক্তব্য -“খিদিরপুরের মতো জায়গায় অভিযুক্তকে ধরতে ও তল্লাশি চালাতে গিয়ে যদি পুলিশকে বাধার সামনে পড়তে হয়, তবে ধরেই নিতে হবে পুলিশের উপরে মানুষের আস্থা কমছে।”

Advertisement

সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

একই মত কলকাতা পুলিশের বিভিন্ন থানার নিচুতলার কর্মীদের একাংশের। তাঁদের অভিযোগ, মানুষের বন্ধু হতে গিয়ে পুলিশ তার নিজের জায়গা থেকে সরে এসেছে। তার ফলেই সাধারণ মানুষ এখন আর পুলিশের উর্দি দেখলে ভয় পান না। সেই সুযোগে পুলিশের উপরে আক্রমণ করছে দুষ্কৃতীরা। যার নবতম সংযোজন বুধবারের ঘটনা।

লালবাজার সূত্রের খবর, ঘটনার সূত্রপাত এক মাস আগে। ওই দিন একটি মোবাইল প্রস্তুতকারী সংস্থার অভিযোগের ভিত্তিতে দিল্লি হাইকোর্টের নির্দেশে ফ্যান্সি মার্কেটে তল্লাশি চালাতে আসে দিল্লি পুলিশের একটি বিশেষ দল। সঙ্গে ছিলেন কলকাতা পুলিশের এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চের (ইবি) অফিসাররা। লালবাজার সূত্রের খবর, তল্লাশি চালানোর সময় বাধা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে ফ্যান্সি মার্কেটের ব্যবসায়ী ও দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে। এক পুলিশকর্তা জানান,ওই দিন পুলিশকে মারধর করা হয়েছিল। বাধা পেয়ে তল্লাশি না চালিয়েই ফিরে যায় দিল্লি পুলিশের দলটি। পরে দিল্লি আদালতে সবিস্তার রিপোর্ট দেয় তারা।

পুলিশ সূত্রের খবর, দিল্লির পুলিশকর্মীদের মারধরের ঘটনা জানতে পেরে ফের দিল্লি হাইকোর্ট জানতে চায় কারা এই দিন পুলিশকর্মীদের মারধর করেছিল। আর সেই ঘটনার তদন্তে নেমেই গুন্ডাদমন শাখার অফিসারেরা বুধবার ফ্যান্সি মার্কেটের সামনে থেকে অভিযুক্ত রাজ ওরফে ফৈয়াজ খানকে গ্রেফতার করেন তাঁরা। এর পরেই শুরু হয় গোলমাল। ঘটনাস্থলে পুলিশের তিনটি গাড়ি ছিল। অভিযোগ, একটি গাড়িতে ধৃত রাজকে নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে বেরোতে পারলেও পুলিশের আরও দু’টি গাড়ি আটকে দেন স্থানীয় ব্যবসায়ী ও দুষ্কৃতীদের একাংশ। শুরু হয় গাড়ি ভাঙচুর। অভিযোগ, তখনই দুষ্কৃতীরা গাড়িতে থাকা পুলিশকর্মীদের নীচে নামিয়ে রাস্তায় ফেলে বাঁশ দিয়ে পেটাতে শুরু করে। সঙ্গে চলতে থাকে কিল, চড়, লাথি। দুষ্কৃতীদের আক্রমণে জখম হন গোয়েন্দা বিভাগের ছ’জন।

তবে লালবাজার সূত্রের খবর, রাত পর্যন্ত জখম পুলিশকর্মীদের প্রাথমিক চিকিত্‌সা চললেও সকলকে ওই রাতেই হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ওই রাতেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ওয়াটগঞ্জ থানায় অভিযোগ দায়ের করেন গুন্ডাদমন শাখার ওসি সৌম্য ঠাকুর। লালবাজার সূত্রে খবর, মারধরের ঘটনায় তিনি অবশ্য জখম হননি। এই ঘটনায় পুলিশ মহম্মদ হালিম, আফতাব আহমেদ, সাজিদ আকবর-সহ আরও ২০০ জন অজ্ঞাতপরিচয়ের বিরুদ্ধে পুলিশকে সরকারি কাজে বাধা দেওয়া, তাঁদের উপর হামলা, দাঙ্গা হাঙ্গামা-সহ একাধিক ধারায় মামলা রুজু করেছে।

এলাকাবাসীদের দাবি ছিল, অভিযুক্ত রাজ জানুয়ারি মাসে পুলিশকর্মীদের মারধরের ঘটনায় যুক্ত নন। গোয়েন্দারা নির্দোষ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে। তাঁদের যুক্তি, আলিপুর থানা ভাঙচুরের ঘটনাতেও শাসক দলের চাপে পুলিশ প্রথমে যে পাঁচ জনকে গ্রেফতার করেছিল, তাঁদের সঙ্গে ওই ঘটনার কোন যোগ ছিল না। যার জেরে আলিপুর আদালতে তীব্র ভর্ত্‌সনার মুখে পড়তে হয় ঘটনার তদন্তকারীদের। বুধবারের ঘটনার পরে কলকাতা পুলিশের তিনটি থানায় ওসি হিসেবে কাজ করা এক পুলিশকর্তার কথায়, “বর্তমান পরিস্থিতির জন্য আমরাই দায়ী। এক দিকে আমরা লাঠি তুলে রেখে পাড়ার দুষ্কৃতীদের সঙ্গে ফুটবল-ক্রিকেট খেলছি। অন্য দিকে রাজনৈতিক চাপে নির্দোষ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করছি।” এর ফলেই মানুষ পুলিশের উপরে ভরসা রাখতে পারছেন না বলে তাঁর মন্তব্য। তবে লালবাজার সূত্রে খবর, বুধবারের ঘটনার পরেও পিছিয়ে আসবেন না তাঁরা। ওই ঘটনায় অভিযুক্তদের ধরতে ফের অভিযান চালানো হবে বলে তাঁরা জানিয়েছেন।

পুলিশের উপরে হামলার এই প্রবণতা দিনে দিনে বাড়বে বলেই মনে করেন সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিত্‌ মিত্র। তিনি বলছেন, “মানুষের অসন্তোষ আসলে সরকারের উপরে। পুলিশ এখানে রাষ্ট্র বা সরকারের প্রতীক। তাই সরকারের উপরে ক্ষোভ-অসন্তোষের প্রকাশটা হচ্ছে তাদের উপরেই। তার উপরে পুলিশও এমন কিছু কাজ করছে, যা সাধারণ মানুষ মানতে পারছেন না। নিচুতলার পুলিশকর্মীদের থেকে মানুষের রাগটা এ বার উপর মহলের দিকে যাচ্ছে কারণ, মানুষ তো জানে নিচুতলার পুলিশ কাজ করে উপরতলার নির্দেশেই।” অভিজিত্‌বাবুর মতে, এই হিংসাত্মক মনোভাবটা আসলে ভিশাস সার্কেল। অপরাধ দমনে পুলিশ হিংসাত্মক হলে, তার প্রতিবাদে মানুষও একই পথে হাঁটছেন। তাতে পুলিশের ক্ষোভ তাদের আরও হিংসাত্মক করে তুলছে। এই পরিস্থিতি দিনে দিনে আরও বড় আকার নেবে বলেই মনে করছেন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন