হকার সমস্যা মানেন সবাই, মেটাতে ‘ঝুঁকি’ নেন না কেউ

হকারের ‘দৌরাত্ম্যে’ দু’দিন ধরে বনধ চলছে নিউ মার্কেট চত্বরের গোটা দশেক বাজারে। কলকাতা পুরসভায় কর দিয়ে ব্যবসা করেন ওই সব বাজারের হাজার পাঁচেক ব্যবসায়ী। এ বাবদ বছরে প্রায় ১৩ কোটি টাকা আয় হয় পুরসভার। পুর-প্রশাসনের কাছে ওঁদের দাবি ছিল, দোকানের সামনে বসে পড়া ওই সব ‘বেআইনি’ হকারের কারণে তাঁদের ব্যবসা মার খাচ্ছে। অন্যত্র সরানো হোক তাঁদের।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০১৫ ০১:০১
Share:

...সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। বনধ চলছে। তাই দোকানের রুদ্ধ দরজার বাইরে থেকেই প্রাত্যহিক পুজো সারছেন এক পুরোহিত। বৃহস্পতিবার, নিউ মার্কেটে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

হকারের ‘দৌরাত্ম্যে’ দু’দিন ধরে বনধ চলছে নিউ মার্কেট চত্বরের গোটা দশেক বাজারে। কলকাতা পুরসভায় কর দিয়ে ব্যবসা করেন ওই সব বাজারের হাজার পাঁচেক ব্যবসায়ী। এ বাবদ বছরে প্রায় ১৩ কোটি টাকা আয় হয় পুরসভার। পুর-প্রশাসনের কাছে ওঁদের দাবি ছিল, দোকানের সামনে বসে পড়া ওই সব ‘বেআইনি’ হকারের কারণে তাঁদের ব্যবসা মার খাচ্ছে। অন্যত্র সরানো হোক তাঁদের। অভিযোগ, সাড়া মেলেনি পুরসভার। একই অভিযোগ, বড়বাজার, শ্যামবাজার, হাতিবাগান, গড়িয়াহাট, ভবানীপুর, রাসবিহারী-সহ শহরের অধিকাংশ বড়-ছোট রাস্তা জুড়ে বসে থাকা হকারের বিরুদ্ধে। অবশ্য প্রতিকার মেলেনি।

Advertisement

উল্টে আজ, শুক্রবার শহরের হকারদের নিয়েই সভা করছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নবান্ন সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রীর মঞ্চ ভরাতে সেখানে হাজার বিশেক হকারকে জড়ো করার চেষ্টা চলছে। এর জন্য সরকারি খরচে বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, হকার ‘ভাই-বোনেদের’ সঙ্গে কথা বলবেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে হকারদের জন্য বিশেষ কোনও নীতির কথাও ঘোষণা করতে পারে সরকার। হকারদের সংযত হওয়ার নির্দেশও দিতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী।

নায্য কর দিয়ে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যবসায়ী, না ‘দখলদার’ হকার— কাদের সমস্যা গুরুত্ব পাবে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে? প্রশ্ন উঠছে তা নিয়ে। পুরকর্তারা অবশ্য এ প্রসঙ্গে কোনও কথা বলতেই রাজি নন। এক অফিসার বলেন, “এমনিতেই বিষয়টি বড় স্পর্শকাতর। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই সবটা দেখছেন। তার উপরে সামনে ভোট। মুখ খোলা বারণ।” তবে পুরসভার অন্দরমহলের খবর, ট্যাক্সি-অটোর পরে ভোটের মুখে হকারদের ‘খুশি’ করতে চায় সরকার। তাই ভোটের বিজ্ঞপ্তির আগে তড়িঘড়ি হকারদের সভা ডাকা হয়েছে। শহরের রাস্থাঘাটে, বাজারের যত্রতত্র হকার বসে পড়ায় অখুশি কলকাতাবাসীও।

Advertisement

‘পুর-প্রশ্নের পুরো জবাব’ চেয়ে পাঠানো বিভিন্ন চিঠিতেও সেই চিত্র।

বালিগঞ্জের বাসিন্দা ঋতপর্ণা রায় চাঁদনি চকে কিছু জিনিস কিনতে গিয়েছিলেন। ফেরার সময়ে প্রায় বাসের তলায় চাপা পড়ার মতো অবস্থা। কপাল গুণে বেঁচে গিয়েছেন। নিজেই সে কথা জানিয়েছেন কলকাতা পুরসভার ৬৭ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার ওই বাসিন্দা। তাঁর বক্তব্য, “ওই জায়গায় বাস-ট্রামের স্ট্যান্ড থাকলেও পুরো ফুটপাথ জুড়ে নানা ধরনের পসরা নিয়ে বসেন হকারেরা। যাত্রীদের দাঁড়ানোর বিন্দু মাত্র জায়গা নেই। তাই বাধ্য হয়ে ট্রাম লাইনের উপরে দাঁড়াতে হয় মানুষজনকে।” যাত্রী তোলার জন্য ওই রাস্তায় যে ভাবে রেষারেষি করে গাড়ি চলে, তাতে তাঁর মতো অনেককেই প্রাণ হাতে নিয়ে চলাফেরা করতে হয় বলে জানান ঋতপর্ণা।

জ্বলন্ত ওই সমস্যা দেখেও ভ্রূক্ষেপ নেই পুর-প্রশাসনের, অভিমত কলকাতা পুরসভার ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডের চাঁদনি চকের একাধিক ব্যবসায়ীরও। সমস্যাটা জানেন স্থানীয় কাউন্সিলর আরজেডি-র সুমন সিংহ। দল পরিবর্তন করে বর্তমানে তিনি তৃণমূলের সদস্য হয়েছেন। বললেন, “বছর দুয়েক আগে পুরসভায় বিষয়টি জানিয়েছিলাম। কোনও কাজ হয়নি। এর মধ্যে আর কিছু করা হয়নি।”

গড়িয়াহাট ও গোলপার্ক দক্ষিণ কলকাতার গুরুত্বপূর্ণ দু’টি সংযোগস্থল। ৬৮ নম্বর ওয়ার্ডের মুকুন্দলাল দত্ত ‘পুর-প্রশ্নের পুরো জবাব’ চেয়ে জানিয়েছেন, রাস্তা জবরদখল হয়ে যাওয়ায় এই দু’টি জায়গা দিয়ে চলাফেরা করা কার্যত অসম্ভব। নিয়ম অনুযায়ী রাস্তার মোড় থেকে ফুটপাথ এবং রাস্তার দু’ধারে ৫০ ফুট ছেড়ে দেওয়ার কথা।

কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ দেবাশিস কুমার বলেন, “আমি নিজেও মনে করি রাস্তার মোড় থেকে ফুটপাথের বেশ কিছু অংশ ছেড়ে দেওয়া প্রয়োজন। এমনকী রাস্তায় যাঁরা বসবেন, তাঁরা তিন ভাগ জায়গা ছেড়ে দেবেন। সমস্ত হকার সংগঠনের সঙ্গেও এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তাঁরা রাজিও হয়েছেন। কিন্তু তবুও তা কার্যকর করা যায়নি।”

বড়বাজার এলাকার ক্যানিং স্ট্রিট জুড়ে বসে থাকেন হকারেরা, জানিয়েছেন ওই এলাকার ব্যবসায়ী রমেন গুপ্ত। সমস্যাটি স্থানীয় কাউন্সিলরের নজরেও আনা হয়েছে। ওই অভিযোগ স্বীকারও করে নেন ৪৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কংগ্রেস নেতা সন্তোষ পাঠক। তাঁর বক্তব্য, “হকারের দৌরাত্ম্য অনেক বেড়েছে। পুরসভাকে বলা সত্ত্বেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।” নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাতিবাগান এলাকার এক বাসিন্দা জানিয়েছেন, হাতিবাগানের ফুটপাথও কার্যত জবরদখল হয়ে গিয়েছে। হাতিবাগান বাজারে প্রবেশ করাই দুষ্কর। বারবার পুর-প্রশাসনকে বলা সত্ত্বেও কেউ কোনও ব্যবস্থা নেননি।

৮৫ নম্বর ওয়ার্ডে অশ্বিনী দত্ত রোডে ফুটপাথ জুড়ে হকার বসে থাকায় হাঁটাচলা করাই সমস্যা। ‘পুর-প্রশ্নের পুরো জবাব’ চেয়ে এই অভিযোগ এক বাসিন্দার। নাম লেখেননি। ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তথা মেয়র পারিষদ দেবাশিস কুমার বলেন, “নিয়ম-নীতি মেনে হকারদের বসার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সমস্ত দলের হকার সংগঠনের প্রতিনিধিরা নিয়ম মানার কথাও জানিয়েছিলেন। কিন্তু তা মানা হচ্ছে না।”

দক্ষিণ কলকাতায় ৯৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা স্বপন ঘোষাল জানিয়েছেন, হরিপদ দত্ত লেনে ঢোকার মুখে হকার বসে যাওয়ায় রাস্তা সরু হয়ে গিয়েছে। প্রচণ্ড সমস্যা হচ্ছে সাধারণ মানুষের। এলাকার কাউন্সিলর আরএসপি-র সেতাবুদ্দিন খন্দকার বলেন, “এই দোকানগুলি ২০০০ সালের আগে থেকেই রয়েছে। আমি ২০০৫ সালে কাউন্সিলর হয়েছি। যাঁরা আগে বসেছেন, তাঁদের আমি তুলি কী করে? আমার সময়ে বসলে তুলে দিতাম।” ‘পুর-প্রশ্নের পুরো জবাব’ চেয়ে গোপালনগর রোডের বাসিন্দা দীপক রায়ের অভিযোগ, “সার্ভে বিল্ডিংয়ের সামনে থেকে গুপ্তা সুইটস পর্যন্ত ফুটপাথের দু’ধারই খাবারের দোকান, হকার, পার্টি অফিস ও গ্যারাজ। যাতায়াতে অসুবিধে হলেও সকলেই নির্বিকার।” এ কথা নাকি জানেনই না ৭৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তৃণমূলের প্রণব বিশ্বাস।

উল্টো চিত্রও রয়েছে। রাজডাঙা-বোসপুকুর এলাকায় ফুটপাথ ঘিরে এক সময়ে ব্যবসা চালাতেন হকারেরা। তাঁদের অন্যত্র সরিয়ে মানুষের চলাচলের রাস্তা করেছেন পুরকর্তারা।

শহর জুড়ে ‘বেআইনি’ হকার-রাজ নিয়ে বিচলিত পুর-প্রশাসনও। যদিও তা খোলা মনে বলতে নারাজ কেউই। মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় এ বিষয়ে জানান, মানবিক কারণেই অনেক সময়ে সরকারকে ভেবে-চিন্তে কাজ করতে হয়। নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ীদের প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী শুক্রবার হকারদের নিয়ে বসছেন। কিছু একটা সমাধান বেরোবে। বন্‌ধ তুলে নিতে উদ্যোক্তাদের অনুরোধ জানিয়েছিলাম। লাভ হয়নি।”

তথ্য: অনুপ চট্টোপাধ্যায় ও কৌশিক ঘোষ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন