কৃপাসিন্ধু খুনে বেকসুর খালাস

পাঁচ বছর পরে সাজা পাবে স্বামীর খুনিরা— সকাল হতে না হতেই এক বুক আশা নিয়ে কাটোয়া আদালতে হাজির হয়ে গিয়েছিলেন মধুমিতাদেবী। নেতার খুনের মামলার রায় শুনতে তাঁর সঙ্গে গ্রাম উজাড় করে এসেছিলেন আরও শ’দেড়েক বাসিন্দা। কিন্তু ‘বেকসুর খালাস’ শুনেই থম মেরে গেলেন সবাই।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কাটোয়া ও বর্ধমান শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০১৬ ০০:৩১
Share:

কাটোয়া আদালত চত্বরে কৃপাসিন্ধুবাবুর স্ত্রী মধুমিতাদেবী ও দুই মেয়ে। —অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।

পাঁচ বছর পরে সাজা পাবে স্বামীর খুনিরা— সকাল হতে না হতেই এক বুক আশা নিয়ে কাটোয়া আদালতে হাজির হয়ে গিয়েছিলেন মধুমিতাদেবী। নেতার খুনের মামলার রায় শুনতে তাঁর সঙ্গে গ্রাম উজাড় করে এসেছিলেন আরও শ’দেড়েক বাসিন্দা। কিন্তু ‘বেকসুর খালাস’ শুনেই থম মেরে গেলেন সবাই।

Advertisement

বুধবার কেতুগ্রাম ১ ব্লক তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক কৃপাসিন্ধু সাহা খুনের রায় ঘোষণা হয়। খুনে অভিযুকেত ছিলেন তৃণমূলের তৎকালীন কেতুগ্রাম ১ ব্লকের কার্যকরী সভাপতি হারা শেখ ও তাঁর সঙ্গী চাঁদ শেখ। আদালত শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই অতিরিক্ত দায়রা বিচারক শ্যামসুন্দর চট্টোপাধ্যায় জানিয়ে দেন, প্রমাণের অভাবে এই মামলা থেকে অভিযুক্তদের খালাস করে দেওয়া হল। মধুমিতাদেবীর পাঁচ বছরের জমা কান্না বাঁধ ভাঙে। পুলিশের তদন্তে গাফিলতির অভিযোগ তোলেন কৃপাসিন্ধুবাবুর দুই মেয়ে। তবে অভিযুক্ত হারা শেখ ও চাঁদ শেখ জেল থেকে ছাড়া পেলেও তাঁরা কান্দরায় গেলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে এই আশঙ্কায় পুলিশ তাঁদের গ্রামে ঢুকতে নিষেধ করেছে বলে জানা গিয়েছে।

ঘটনায় পুলিশের গাফিলতি দেখছে যুযুধান দুই রাজনৈতিক দলও। তৃণমূলের কয়েকজন নেতারও দাবি, পুলিশের তদন্তে ফাঁক-ফোকর ছিল বলেই খালাস হয়ে গেলেন অভিযুক্তেরা। আবার সিপিএম নেতাদের কথায়, এই ঘটনায় রায় মনে করিয়ে দিচ্ছে কেতুগ্রামের ছোট রেলে নির্যাতিতা মহিলার কথাও ওই মামলাতেও সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে গিয়েছিল অভিযুক্তেরা। যদিও দুটি মামলাতেই অভিযুক্তদের অন্যতম আইনজীবী ধীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “তদন্তের গাফিলতি থাকায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ আদালতে পেশ করতে পারেনি পুলিশ। কী কী গাফিলতি রয়েছে, বুধবার বিচারক তার রায়ে সুস্পষ্ট ভাবে জানিয়েছেন।”

Advertisement

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালের ৩১ ডিসেম্বর বৈঠক সেরে বাড়ি ফেরার পথে আমগড়িয়া ক্যানাল পাড়ে খুন হয়ে যান কেতুগ্রাম ১ ব্লক তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক, বছর বিয়াল্লিশের কৃপাসিন্ধু সাহা। কান্দরার বাসিন্দা ওই নেতা তৃণমূলের গোষ্ঠী-রাজনীতিতে বিদায়ী বিধায়ক শেখ সাহানেওয়াজের অনুগামী ছিলেন। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, কান্দরা গ্রামেরই বাসিন্দা তারাশঙ্কর পণ্ডিত পুলিশকে জানিয়েছিলেন, কৃপাসিন্ধুবাবুর মোটরবাইকে চেপে স্থানীয় মালগ্রাম থেকে কান্দরায় ফেরার সময় ঘটনাটি ঘটেছিল। তিনি কেতুগ্রাম থানায় কান্দরা গ্রামেরই হারা শেখ, চাঁদ শেখ ও আসাদুল্লা শেখের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। তিন অভিযুক্তই তৃণমূলেরই নেতা-কর্মী হিসেবে এলাকায় পরিচিত। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে কলকাতার তপসিয়া থেকে হারাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তার কিছু দিনের মধ্যেই চাঁদ শেখ আত্মসমর্পণ করেন। তবে আসাদুল্লা শেখ অধরাই রয়ে যান। অভিযুক্তেরা ধরা পড়ার ৮৯ দিনের মধ্যে আদালতে চার্জশিট পেশ করে ‘কাস্টডি ট্রায়াল’ চেয়ে আবেদন করেছিল তদন্তকারী অফিসার। গত বছর মে মাসে তিনি আদালতে দাঁড়িয়ে হারা ও চাঁদ শেখকে চিনিয়ে দেন। তবে আসাদুল্লার খোঁজ মেলেনি। পরে ধীরে ধীরে ১৪ জন সাক্ষ্য দেন। মঙ্গলবার এই মামলার রায় দেওয়ার কথা থাকলেও শেষ মূহুর্তে বিচারক বুধবার রায় দেবেন বলে জানান।

আইনজীবীরা জানিয়েছেন, এ দিন বিচারক তাঁর রায়ের প্রতি ছত্রে তদন্তে পুলিশের গাফিলতির কথা তুলে ধরেছেন। বিচারক জানিয়েছেন, নিহতের পরিজনেরাই এই মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন। অথচ ঘটনাস্থল, মালগ্রামের আমগড়িয়া ক্যানালের কাছে কোনও গ্রামের এক জনেরও সাক্ষ্য পুলিশ নেয়নি। এফআইআরের পর পুলিশ দুটি রিপোর্ট আদালতে জমা দিয়েছিল, কিন্তু দুটি রিপোট দু’রকম ছিল। ময়না-তদন্ত অনুযায়ী, নিহতের হাতে ও গলার কাছে গুলি লেগেছিল। কিন্তু তাঁর জামা-কাপড় পুলিশ বাজেয়াপ্ত করে কোনও রকম পরীক্ষা করেনি। ফলে, আদালত জানতেও পারেনি, কী ভাবে গুলি লেগেছিল। বিচারক আরও জানান, অস্ত্র যেমন উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ, তেমনি ঘটনাস্থল থেকে বাজেয়াপ্ত করা জিনিসপত্রের ফরেন্সিক বা ব্যালিস্টিক রিপোর্টও আদালতে পেশ করতে পারেনি। এমনকী, পুলিশ মোটরবাইকটিও বাজেয়াপ্ত করে আদালতে পেশ করেনি। সরকারি আইনজীবী তাপস মুখোপাধ্যায় অবশ্য পুলিশের ‘গাফিলতি’ মেনে নিয়েও বলেন, “অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সাজা দেওয়ার মতো প্রচুর প্রমাণ ছিল। আমরা এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাব।”

কেতুগ্রামের তৃণমূলের প্রার্থী শেখ সাহানেওয়াজ বলেন, “প্রকাশ্যে এক জন মানুষকে খুন হতে হল। তদন্তে গাফিলতির জন্যই তাঁর পরিবার বিচার পেল না।” সিপিএমের প্রার্থী সৈয়দ আবুল কাদেরও বলেন, “তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে ওই খুন হয়েছিল। তবুও আমরা মনে করি, পুলিশের গাফিলতিতে কেতুগ্রামের নির্যাতিতা মহিলা থেকে ওই নিহতের পরিবার কেউই বিচার পেলেন না।” বর্ধমান জেলা পুলিশের তৎকালীন এক আধিকারিক বলেন, “সেই সময়ের সব কথা এখন মনে নেই। তবে সঠিক তদন্ত করে আদালতে চার্জশিট জমা দেওয়া হয়েছিল।”

আর মধুমিতাদেবী বলেন, ‘‘অনেক আশা করেছিলাম স্বামীর খুনে বিচার পাব। তবে ভেঙে পড়ছি না।’’ তাঁরা উচ্চ আদালতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেবেন বলেও জানান কৃপাসিন্ধুবাবুর পরিজনেরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন