বাড়ি ফিরে কুণাল বললেন, ভাবতে পারছি না

সিঁড়ি বেয়ে উঠে নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকতেই চোখ চলে গেল সামনের দেওয়ালে টাঙানো সোনালি ফ্রেমটার দিকে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পরে প্রথম বার যে দিন প্রণব মুখোপাধ্যায় কলকাতায় এসেছিলেন, ছবিটা সে দিনের। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গী হয়ে বিমানবন্দরে তিনিও তখন গিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতিকে স্বাগত জানাতে।

Advertisement

দেবারতি সিংহচৌধুরী

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:১১
Share:

মানিকতলায় নিজের বাড়িতে ছেলের সঙ্গে কুণাল ঘোষ। ছবি: শৌভিক দে।

সিঁড়ি বেয়ে উঠে নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকতেই চোখ চলে গেল সামনের দেওয়ালে টাঙানো সোনালি ফ্রেমটার দিকে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পরে প্রথম বার যে দিন প্রণব মুখোপাধ্যায় কলকাতায় এসেছিলেন, ছবিটা সে দিনের। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গী হয়ে বিমানবন্দরে তিনিও তখন গিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতিকে স্বাগত জানাতে। অপলকে সে দিকে তাকিয়েই দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে বেরিয়ে এল কথাটা— ‘‘মেলানো যায়? ওই কুণাল ঘোষের সঙ্গে আমাকে! কত বদল!’’

Advertisement

ছবির হাসিখুশি মুখটার সঙ্গে এই জেলফেরত কুণালকে মেলানো কঠিন বইকি! চেহারায় বদল এসেছে। চুল লম্বা হয়েছে অনেকটা। চোখেমুখে উদ্বেগ আর ক্লান্তির ছাপটা যেন গেঁথে বসে গিয়েছে!

সারদা মামলায় গ্রেফতার হয়ে টানা দু’বছর এগারো মাস জেল খেটে শুক্রবার সকালেই প্রেসিডেন্সি জেল থেকে জামিনে ছাড়া পেয়েছেন রাজ্যসভার এই সাসপেন্ডেড তৃণমূল সাংসদ। আইনজীবী অয়ন চক্রবর্তীকে সঙ্গে নিয়ে রাজা রামমোহন রায় রোডের ফ্ল্যাটে যখন পৌঁছলেন, তখন বেলা প্রায় ১১টা। কপালে লাল সিঁদুরের টিপ, পরনে ঘিয়ে রঙের আফগানি কুর্তা-সালোয়ার, পায়ে সাদা স্নিকার্স। বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নেমেও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না! বললেন, ‘‘ভাবতেই পারছি না, ষষ্ঠীর দিন বাড়ি ফিরলাম তা হলে!’’

Advertisement

ফ্ল্যাট-বাড়ির সামনের ছবিটাও অনেক বদলে গিয়েছে আগের চেয়ে। বছর তিনেক আগেও গেটের বাইরে অহোরাত্র ভিড় লেগে থাকত ‘কুণালদা’র জন্য! মুখ্যমন্ত্রীর খুব কাছের মানুষ হিসেবে ‘দাদা’র ধারাবাহিক উত্থান তখন তৃণমূলের অতি বড় নেতার কাছেও ঈর্ষার বিষয়! এখন সব খাঁ খাঁ করছে। গাড়ি থেকে কুণালই এগিয়ে গেলেন কয়েক পা দূরে পাড়ার মণ্ডপে। পড়শিরা কেউ কেউ এগিয়ে এলেন দেখতে পেয়ে। আবেগে কেঁদেও ফেললেন দু-এক জন। কেউ বা বললেন, ‘‘আগের মতোই পাড়ার পুজোয় থাকতে হবে কিন্তু।’’ এতক্ষণে কুণালের মুখে হাসি দেখা গেল। তবে আনন্দের তুলনায় সেই হাসি অসহায়তার ভারে যেন ক্লান্ত! তার পর বললেন, ‘‘এখন তো বাড়ি আর পাড়া ছেড়ে কোথাও যেতে পারব না রে। কোর্টের তো তেমনই আদেশ।’’ আদালতের নির্দেশ মেনে আজ সপ্তমীর দুপুরে সল্টলেকে সিবিআই দফতরে তাঁর হাজিরা দেওয়ার কথা।

জেল থেকে বেরনোর সময়ে এ দিন কুণালের পরিবারের কাউকে দেখা যায়নি সেখানে। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মা মণিকাদেবী হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। শাশুড়িকে বাড়ি নিয়ে আসতে কুণালের স্ত্রী শর্মিতা সেখানেই গিয়েছিলেন। ফ্ল্যাটে ঢুকে কুণালের প্রথমে দেখা হয় ছেলে কুন্তলের সঙ্গেই। শুরুতে কিছুটা দূর থেকেই বাবাকে দেখছিল রসায়নের প্রথম বর্ষের ছাত্র কুন্তল। থমথমে মুখে বারবার চশমা সরিয়ে চোখ মুছে নিচ্ছিল। ‘‘টাট্টু, এ দিকে আয়,’’ বলে কুণালই ডেকে নিলেন তাকে। তার পরে ছেলের পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘‘ও আমাকে খালি বলত, বাবা মাথা ঠান্ডা রেখো। ভাল হয়ে থেকো।’’ ছেলের কথামতো ভাল হয়েই ছিলেন কুণাল। বললেন, ‘‘লেখাপড়ার মধ্যেই ছিলাম। তিনটে শারদসংখ্যা পড়ে ফেলেছি এই ক’দিনে। পাঁচটা উপন্যাস লিখেছি। কয়েক দিন পরই ‘হে বান্ধবী’ নামে আমার প্রথম বইটা বেরোবে। টাট্টুই ওই বইটার প্রচ্ছদ আঁকছে।’’ বিষয় কী সেই বইয়ের? কুণালের উত্তর, ‘‘দ্রৌপদীর কাছে শ্রীকৃষ্ণের অপরাধ স্বীকারের কথা।’’ সেটা আসলে তাঁর নিজেরই কথা কি না, তা অবশ্য স্পষ্ট করে বললেন না। শুধু জানালেন, ‘‘সুসময়ে অনেককে পাশে পেয়েছি। কিন্তু এই কঠিন সময়ে যে কয়েক জন আত্মীয়-বন্ধু, পুলিশ, জেলের আধিকারিক, জেলরক্ষী ও বন্দিরা আমাকে আগলে রেখেছেন, তাঁদের কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব!’’

দুপুরে বাড়ি ফিরে আসেন কুণালের অসুস্থ মা-ও। তার পরে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কেঁদে ফেলেন অশীতিপর বৃদ্ধা।

স্বজন-বন্ধু ছাড়া তৃণমূলের কোনও নেতা অবশ্য এ দিন দেখা করেননি কুণালের সঙ্গে। শাসক দলের কেউ ফোন করেছেন বলেও খবর নেই। তবে দলের এক শীর্ষ নেতা বলেন, ‘‘ওঁকে অনেক দিন জেল খাটতে হল বলে খারাপই লাগছে। ওঁকে দেখে দলের অনেকেরই শিক্ষা নেওয়া উচিত।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন