চলছে উদ্ধারকাজ। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।
বিজ্ঞানীরা পূর্বাভাস দিয়েই রেখেছিলেন। তা মিলে যেতেও দেরি হল না। প্রচণ্ড অস্থিরতা বুকে ধরে গুমরোতে থাকা দার্জিলিঙের পাহাড় আচমকা ফুঁসে উঠে নামিয়ে দিল প্রলয়ঙ্কর ধস!
দু’মাস আগে নেপালে পরের পর দু’টো অতীব শক্তিশালী ভূকম্পের জেরে নেপাল-দার্জিলিং হিমালয়ের নানা জায়গায় অসংখ্য চিড় ধরেছে। এর পরে নেমেছে বর্ষা। ভূ-বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা ছিল, চিড়গুলো দিয়ে বৃষ্টির জল পাহাড়ের ভিতরে ঢ়ুকে মাটি আলগা করে দেবে। এবং এক সময় জলের স্রোতের সঙ্গে সেই কাদা-মাটি নেমে আসবে নীচে।
মঙ্গলবার রাতে দার্জিলিঙের পাহাড় জুড়ে তা-ই হয়েছে। কাদার স্রোতের সঙ্গে মাটি, পাথর, গাছপালা— সব এক সঙ্গে নেমে এসেছে নীচের দিকে। ধূলিসাৎ করে দিয়েছে একের পর এক জনপদ।
তবে ঘটনার জন্য প্রকৃতির উপরে মানুষের ‘আগ্রাসন’কেও দায়ী করছেন ভূ-বিজ্ঞানীদের একাংশ। এঁদের আক্ষেপ, প্রাকৃতিক কারণে পাহাড়ে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বিপর্যয়ের মাত্রা বাড়িয়েছে মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ড। উন্নয়নের নামে যত গাছ কাটা পড়ছে, মাটি তত আলগা হয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে অল্প বৃষ্টিতেই ধস নামার প্রবণতা।
পাশাপাশি পাহাড়ে রাস্তা তৈরির পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞদের অনেকের অভিযোগ, কোথায় রাস্তা বানালে ভূ-স্তরের ভারসাম্যে আঘাত পড়বে না, সেটা মাথায় না-রেখে যথেচ্ছ নির্মাণ হচ্ছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক তাপস ভট্টাচার্যের পর্যবেক্ষণ, ‘‘এক দিকে গাছ কাটা হচ্ছে নির্বিচারে। আবার রাস্তা তৈরির সময়ে খেয়াল থাকছে না যে, পাহাড়ের ঢাল কোন দিকে। ভারসাম্য শিকেয় উঠছে।’’
এমতাবস্থায় বিশেষজ্ঞেরা সতর্ক করেছেন, বৃষ্টি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিত্যনতুন এলাকায় পাহাড়ের ঢাল বেয়ে কাদার স্রোত নেমে আসবে। আরও ধস নামবে। ‘‘কোথাও জীবন বা সম্পত্তিহানি ঘটলে আমরা খবর পাচ্ছি। জানতেই পারছি না, নেপাল-দার্জিলিং-সিকিমে কত বসতিহীন অঞ্চল এ ভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে!’’— বলছেন তাপসবাবু। তাঁর অভিমত, ‘‘গত ২৫ এপ্রিলের ৭.৮ রিখটার স্কেলের ভূমিকম্প এ তল্লাটের হিমালয়কে সাংঘাতিক অস্থির করে তুলেছে। এ সব তারই পরিণাম।’’
একই কথা শোনা যাচ্ছে অন্যান্য বিশেষজ্ঞের মুখেও। যেমন খড়্গপুর আইআইটি’র ভূ-পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক শঙ্করকুমার নাথের দাবি: নেপালে দু’টি বড় মাপের ভূমিকম্পের সময়ে ভূ-স্তরের ‘ইন্ডিয়ান প্লেট’ পিছলে ঢুকে গিয়েছিল ‘ইউরেশীয় প্লেটের’ ভিতরে, যার প্রতিক্রিয়ায় ছোটখাটো পরমাণু বোমার সমান শক্তি উৎপন্ন হয়। সেই শক্তি এখনও মিলিয়ে যায়নি, তা মাঝে-মধ্যেই নিজিকে জাহির করছে। মূল ভূমিকম্প-পরবর্তী শতাধিক কম্পন (আফটারশক) হয়েছে। তার পরেও ভূস্তর স্থিতিশীল হয়নি। ভূ-কম্পনের কেন্দ্রস্থলগুলি থেকে শক্তি নির্গত হয়েই চলেছে। ‘‘বাইরে থেকে হয়তো বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু প্রতি বার শক্তি নির্গমনের সময়ে পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট চিড় বা ফাটল তৈরি হচ্ছে। তা দিয়ে বৃষ্টির জল ঢুকে পাহাড় আরও ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে।’’— বলেন শঙ্করবাবু।
বস্তুত পাথরের গঠনগত প্রকৃতির সুবাদে হিমালয়ের অন্যান্য অংশের তুলনায় দার্জিলিং, নেপালের পাহাড় বরাবরই বেশি ধসপ্রবণ। জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া (জিএসআই)-র অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল বিমলেন্দু দে’র বিশ্লেষণ, ‘‘হিমালয়ের এই অংশটির বয়স অপেক্ষাকৃত কম। এখানে বিস্তর বহু চ্যুতি (ফল্ট)-ও রয়েছে। তাই বেশি অস্থির। ধসের আশঙ্কাও বেশি।’’
সঙ্গে এখন জুড়েছে নেপালের কালান্তক ভূমিকম্প ও শতাধিক আফটারশকের ঠেলা। সব মিলিয়ে পাহাড়ের অন্দরমহলে উথালপাথাল। এক বিজ্ঞানীর মন্তব্য, ‘‘যে ভূমিকম্প খোদ মাউন্ট এভারেস্টকে তিন সেন্টিমিটার পর্যন্ত ঠেলে সরিয়ে দিতে পারে, তা কোথায় কত চোরাগোপ্তা ধ্বংসলীলা চালিয়েছে, কে জানে?’’— আর তাপসবাবুর আশঙ্কা, পাহাড়ে বৃষ্টি চলতে থাকায় জানা যাচ্ছে না, নেপাল-দার্জিলিং-সিকিমের পাহাড়ে কোথায় ধস নেমে নদীর বুকে পাথর-কাদার স্তূপ জমে রয়েছে। ‘‘নদীগুলোয় যখন-তখন হড়পা বান আসতে পারে। তাতে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে।’’— হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।
ধসের পিছনে তা হলে কি ভূমিকম্পেরই আসল ভূমিকা?
অনেকে অবশ্য এমনটা মানতে রাজি নন। যেমন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলের বিভাগীয় প্রধান সুবীর সরকার। বিপর্যয়ের পিছনে মানুষের ভূমিকাই যিনি বেশি দেখছেন। বলছেন, ‘‘এ ক্ষেত্রে নেপালের ভূকম্পের প্রভাবের চেয়েও মানুষের হস্তক্ষেপ (ম্যান ইনডিউসড ন্যাচারাল প্রসেস)-কে আমি বেশি দায়ী করতে চাই।’’
এবং সুবীরবাবুদের আশঙ্কা, এ হেন আত্মঘাতী প্রবণতা উত্তোরত্তর বাড়তেই থাকবে। পাল্লা দিয়ে আলগা হবে পাহাড়ের মাটিও।