জখম বিমান, আগ্রাসী বামেরা

সকালেই ইঙ্গিত ছিল, দিনটা এ বার অন্য রকম যাবে! ‘ফর্মাল’ পোশাকে কোনও অনুষ্ঠানে যাওয়া ছা়ড়া চটি পায়েই সচরাচর দেখা যায় তাঁকে। কিন্তু বৃহস্পতিবার রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে ম্যাটাডোর-মঞ্চে যখন উঠলেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র, পায়ে স্নিকার্স! বোঝা যাচ্ছিল, এ দিন আর নাম-কা-ওয়াস্তে আন্দোলন দেখিয়ে পিছু হঠার দিন বোধহয় নয়!

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০১৫ ০৩:১৩
Share:

বামেদের নবান্ন অভিযানে পুলিশকে চ্যালেঞ্জ। বৃহস্পতিবার। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।

সকালেই ইঙ্গিত ছিল, দিনটা এ বার অন্য রকম যাবে! ‘ফর্মাল’ পোশাকে কোনও অনুষ্ঠানে যাওয়া ছা়ড়া চটি পায়েই সচরাচর দেখা যায় তাঁকে। কিন্তু বৃহস্পতিবার রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে ম্যাটাডোর-মঞ্চে যখন উঠলেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র, পায়ে স্নিকার্স! বোঝা যাচ্ছিল, এ দিন আর নাম-কা-ওয়াস্তে আন্দোলন দেখিয়ে পিছু হঠার দিন বোধহয় নয়! প্রস্তুতি আছে লড়ে যাওয়ার।

Advertisement

দিন শেষে হল তা-ই। আবার পুরোটা হলও না! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় এই প্রথম বার সে অর্থে জঙ্গি আন্দোলনে গেল বামেরা। আবার সেই আন্দোলনে ব্রেক ফেলে দিলেন বাম নেতৃত্বই!

পুলিশের হাতে আক্রান্ত হওয়ার অভিযোগ নিয়ে আগামী ২ সেপ্টেম্বরের সাধারণ ধর্মঘটের আগে নতুন উদ্যমে পথে নামার রসদ তাঁরা আদায় করে নিলেন। আবার এ দিনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৎক্ষণাৎ যে স্তরের তীব্র আন্দোলনে পৌঁছে যাওয়া যেত, সেই পর্যন্ত তাঁরা গেলেন না। সূর্যবাবুদের ঘোষণা ছিল, বিকেল ৪টের পরে আর রাস্তায় কোনও কর্মকাণ্ড হবে না। ঘড়ি ধরে ঠিক ৪টেতেই শেষ হয়ে গেল অভিযান। ময়দানের ফাঁক-ফোকর দিয়ে বিচ্ছিন্ন ভাবে লোক দৌড়লে নিশ্চিত ভাবেই আরও বিপাকে পড়ত পুলিশ। বাম নেতৃত্বের কড়া অনুশাসনে জমায়েতের বাইরে সেই পথে কেউ যাননি!

Advertisement

বস্তুত, ‘নবান্ন অভিযানে’র অবসরে বামেদের লক্ষ্য ছিল বিধানসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে সংগঠনকে চাঙ্গা করা। আন্দোলনের কড়া চেহারা কেন দেখা যাচ্ছে না, তা নিয়ে কর্মী-সমর্থকদের একাংশের নিরাশা দূর করা। পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধে জড়িয়ে বাম কর্মী-সমর্থকদের যে জঙ্গি মেজাজ এ দিন কলকাতা ও হাওড়ায় দেখা গিয়েছে, তাতে তাঁদের প্রাথমিক লক্ষ্য অনেকটাই সফল বলে মনে করছেন বাম নেতৃত্ব। কর্মী বাহিনীকে পুলিশের হাতে মার খেতে দেখে রাস্তায় এগিয়ে গিয়ে মার খেয়েছেন স্বয়ং বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুও। ফলে, সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার নজিরও এ দিন রাখতে পেরেছেন বিমানবাবুরা। তবে একই সঙ্গে কেউ কেউ বলছেন, বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন মমতা এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ-প্রশাসনকে যতটা কোণঠাসা করে ফেলতেন, সেই পথে যায়নি বামেরা। নির্দিষ্ট গণ্ডির পরে আন্দোলনের রাশ টেনে ধরা হয়েছে। এমনকী, তুলনায় উঠে আসছে মমতার নেতৃত্বে ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই যুব কংগ্রেসের ‘মহাকরণ অভিযানে’র কথাও। তবে সে দিন আন্দোলনকারীরা অনেক বেশি বল্গাহীন ছিলেন। পাশাপাশি, পুলিশও এ দিনের মতো সংযত ছিল না।

রাস্তা থেকে ইট কুড়িয়ে চলছে পাল্টা মার। তার মধ্যেই পালাতে গিয়ে উল্টে পড়ল পুলিশ। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

বাম নেতারা অবশ্য যুক্তি দিচ্ছেন, প্রতিরোধের রাস্তায় গেলেও তাঁরা যে দায়িত্বজ্ঞানহীন আন্দোলন করেন না, বিধানসভা ভোটের আগে সেই বার্তা জারি রাখাও জরুরি ছিল। তাই পুলিশের লাঠির জবাবে পাল্টা প্রতিরোধ হলেও কখনও নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা হয়নি। সূর্যবাবু যেমন বলেছেন, ‘‘নবান্ন দখল করতে যাওয়ার কোনও উদ্দেশ্য আমাদের ছিল না! কথা ছিল, নবান্ন পর্যন্ত মিছিল করে যাওয়া হবে। পুলিশ বাধা দিয়ে ব্যারিকেড করেছে, বাধা ভাঙাও হয়েছে। যা যা হয়েছে, তার দায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর!’’ সেই সঙ্গেই সূর্যবাবুর তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য, ‘‘তৃণমূল সরকারের জন্য আরও যোগ্য জবাব এর পরে অপেক্ষা করছে!’’

গত কয়েক বছরে বামেদের বারেবারেই সমালোচনা শুনতে হয়েছে, তাদের আন্দোলনে ঝাঁঝ নেই। বামফ্রন্টের অন্দরেও এই নিয়ে আক্ষেপ কম নেই। এ দিন ময়দান সংলগ্ন ডাফরিন ও রেড রোড, হেস্টিংসের কাছে খিদিরপুর মোড়, হাওড়ায় ফোরশোর রোড ও সাঁতরাগাছিতে অন্তত সেই আক্ষেপ অনেকটাই মিটিয়ে নিতে পেরেছেন বাম নেতৃত্ব। বামফ্রন্টের সঙ্গে এ দিন সামিল ছিল এসইউসি-সহ ১৭টি বাম দল। বিমানবাবু ছা়ড়াও সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, বিধায়ক শাজাহান চৌধুরী ও বাসুদেব খাঁ, সিপিএমের গার্গী চট্টোপাধ্যায়, আরএসপি-র মনোজ ভট্টাচার্য, সিপিআইয়ের প্রবীর দেব প্রমুখ অল্প-বিস্তর আহত হয়েছেন। সিপিএমের পলিটব্যুরো বিবৃতি দিয়ে বলেছে, ‘পুলিশকে দিয়ে বর্বর আক্রমণ করিয়ে তৃণমূল সরকার বুঝিয়ে দিয়েছে, গণতান্ত্রিক অধিকারকে তারা কতটা ঘৃণা করে!’।

পুলিশি আচরণের প্রতিবাদে আজ, শুক্রবার রাজ্য জু়ড়ে মিছিল, পথসভা করার ডাক দিয়েছেন বিমানবাবুরা। বামেদের পাশে দাঁড়িয়েই প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেছেন, ‘‘বামেদের আমলে পুলিশি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন যে মমতা, তিনিই পুলিশি সন্ত্রাসকে হাতিয়ার করলেন!’’

মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী মমতা প্রত্যাশিত ভাবেই পুলিশের পাশে দাঁড়িয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী এ দিন নবান্নে ছিলেন না। উত্তরবঙ্গ থেকে ফিরে সন্ধ্যায় তিনি এসএসকেএম হাসপাতালে গিয়েছিলেন খণ্ডযুদ্ধে আহত পুলিশকর্মীদের দেখতে। বেরোনোর সময়ে প্রশ্নের জবাবে তাঁর মন্তব্য, ‘‘যে ভাবে তাণ্ডব চালানো হয়েছে, এত পুলিশ এবং সাংবাদিক তার শিকার হয়েছে। সব খোঁজ নিচ্ছি। বাকি যা বলার কাল (শুক্রবার) নবান্ন-তে বলব।’’ পুলিশ লাঠি না চালালে ঘটনা এত দূর গড়াত না বলে অনেকে মনে করছেন। ক্ষুব্ধ গলায় মমতা তখন প্রশ্নকর্তার দিকে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন, ‘‘আপনারা কি সিপিএম-কে এখনও প্রোটেকশন দেওয়ার কাজ করে যাচ্ছেন?’’

মুখ্যমন্ত্রী বিশদ মন্তব্যে না গেলেও শাসক দলের তরফে আসরে নেমে বর্ষীয়ান নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায় কিছুই বাকি রাখেননি। কখনও বলেছেন, মিছিলে লোকের চেয়ে ইটের সংখ্যা বেশি ছিল! কখনও বলেছেন, সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম পকেটে করে ইট নিয়ে গিয়েছিলেন (যার জবাবে সেলিম পাল্টা বলেছেন, ‘‘আমার পকেটে কী ছিল, উনি জানলেন কী করে? পকেটের দিকে নজর কাদের থাকে?’’)! কখনও আবার দাবি করেছেন, বিমানবাবু ‘নাটক’ করে অন্যের রক্ত নিজের মাথায় লেপেছেন! সুব্রতবাবুর কটাক্ষ, ‘‘বিগত কয়েক দিন ধরে সূর্যবাবু কর্মীদের বলছিলেন, আমাদের মার খেতে হবে। ফলে এমন কাজ কর, যাতে মার খেতে হয়!’’ যার জবাব দিতে না চাইলেও সূর্যবাবু শুধু এইটুকু বলেছেন, ‘‘যে দলের গুলিতে গার্ডেনরিচে পুলিশ মারা যায়, যাদের হাত থেকে বাঁচতে পুলিশ টেবিল বা ফাইলের তলায় লুকোয়, তাদের মুখে অন্যদের দিকে পুলিশকে আক্রমণের অভিযোগ মানায় না!’’

রাতে সিপিএমের কৃষক সভার নেতা মদন ঘোষ অবশ্য অনেকটা বিরোধী নেত্রী মমতার কায়দায় ‘চক্রান্তে’র তত্ত্ব এনে ফেলছেন। পুলিশকে লক্ষ করে ইট ছোড়াকে ‘অবাঞ্ছিত’ বলে মন্তব্য করে মদনবাবু বলেছেন, ‘‘আমরা আশঙ্কা করেছিলাম, মিছিলে বাইরের লোক ঢ়ুকিয়ে গন্ডগোল পাকানো হবে। তা-ই হয়েছে। সাদা পোশাকে সিভিক ভলান্টিয়ার-সহ কিছু প্রশিক্ষিত লোক ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারাই ইট ছোড়ে। যাতে পুলিশ লাঠি চার্জ করতে পারে!’’ প্রত্যাশিত ভাবেই পুলিশ অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে।

চাঙ্গা হয়ে পুলিশ-প্রশাসনের সঙ্গে টক্কর নেওয়ার দিনেও বাম সমর্থকদের অনেকে অবশ্য বাড়ি ফিরেছেন একটি আক্ষেপ নিয়ে। এমন কর্মসূচিতে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সামান্য উপস্থিতিও আরও বড় টনিকের কাজ করতে পারত!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন