এই কান ধরছি, বিয়ে আর নয়, বললেন কৃপার বাবা

‘‘এই কান ধরছি। আঠারো না হওয়া পর্যন্ত আর মেয়ের বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব না। ভুলেও না। বিয়ের কথা মুখেই আনব না। অনেক শিক্ষা হয়ে গিয়েছে। এক কথায় এত কাণ্ড! এখন মেয়েকে বাড়িতে ফেরত নিয়ে যেতে পারলে বাঁচি।’’তেরো বছরের মেয়েকে যখন প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে, সেই সময় মঞ্চ থেকে খানিকটা দূরে বসে কথাগুলো বলছিলেন ধানতলা থানার হাজরাপুর হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেনীর প্রতিবাদী ছাত্রী কৃপা মণ্ডলের বাবা শঙ্কর মণ্ডল।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

রানাঘাট শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৬ ০১:৪৫
Share:

সংবর্ধনা কৃপাকে। — নিজস্ব চিত্র।

‘‘এই কান ধরছি। আঠারো না হওয়া পর্যন্ত আর মেয়ের বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব না। ভুলেও না। বিয়ের কথা মুখেই আনব না। অনেক শিক্ষা হয়ে গিয়েছে। এক কথায় এত কাণ্ড! এখন মেয়েকে বাড়িতে ফেরত নিয়ে যেতে পারলে বাঁচি।’’

Advertisement

তেরো বছরের মেয়েকে যখন প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে, সেই সময় মঞ্চ থেকে খানিকটা দূরে বসে কথাগুলো বলছিলেন ধানতলা থানার হাজরাপুর হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেনীর প্রতিবাদী ছাত্রী কৃপা মণ্ডলের বাবা শঙ্কর মণ্ডল।

শঙ্করবাবু পেশায় কৃষিমজুর। চার মেয়ে ও এক ছেলে। মেয়েদের মধ্যে কৃপাই সবচেয়ে ছোট। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বাকি ছিল কৃপাই। তিনি বলেন, “ছোট মেয়ের বিয়ের কথা অনেকেই বলেন। মাস চারেক আগে কয়েক জন দেখতেও আসেন। তাঁদের বারণ করে দিয়েছি। এখন মেয়ের বিয়ে দেওয়ার কোনও ইচ্ছাই নেই আমাদের।”

Advertisement

চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বদলে গিয়েছে ছবিটা। কাল স্কুলের স্টাফরুমে গিয়ে শিক্ষকদের সামনে কেঁদে ফেলেছিল কৃপা। ছোট্ট মেয়েটা বলে, ‘‘স্যার, বাবা বিয়ে দিয়ে দেবে। দয়া করে আমার বিয়ে বন্ধ করুন। আমি এখন বিয়ে করব না। আমি লেখাপড়া করতে চাই।” তাকে দেখে সাহস পেয়ে এগিয়ে এসে তার দিদিও। নবম শ্রেনীর ছাত্রী মিতালি মণ্ডল। স্কুলের শিক্ষক কমলেশ মজুমদার পুলিশ ও প্রশাসনকে বিষয়টি জানান। দু’টি মেয়েই এখন কৃষ্ণনগর চাইল্ড হোম ফর গার্লসে রয়েছে।

মিতালির বাবা পরিমল মণ্ডলের অবশ্য দাবি, গোটাটাই ভুল বোঝাবুঝি। মেয়ের বিয়ের কথা তিনি ভাবেনইনি। পরিমলবাবু বলেন, “কী কাণ্ড ঘটল বলুন তো, একেবারে নাজেহাল হয়ে গেলাম। শুক্রবার মেয়ে স্কুলে যায়নি। তাই, বলেছিলাম লেখাপড়া করছিস না, তোকে বিয়ে দিয়ে দেব। সেই কথা নিয়ে কী কাণ্ড। আমি কি সত্যিই ওর বিয়ে দিতে চাইছি!”

পরিমলবাবু পেশায় দিনমজুর। তার তিন মেয়ে। মিতালি মেজ। বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ছোট মেয়ে ওই স্কুলেই ষষ্ঠ শ্রেনীতে পড়ে। পরে আবার নিজেই বলেন, “বোঝেনই তো গ্রামের ব্যাপার। অনেকেই মেয়ের বিয়ের কথা বলে। আমি রাজি হইনি কখনও। বয়স না হলে বিয়ে দেওয়া ঠিক নয়।”

রবিবার দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ তাদের নিয়ে আসা হয়েছিল রানাঘাট ২ নম্বর ব্লক অফিসে। এ দিন সেখানে ব্লক প্রশাসনের পক্ষ থেকে কন্যাশ্রী দিবসের আয়োজন করা হয়েছিল। চাইল্ড লাইনের কর্মী এবং পুলিশের সঙ্গে তারা দুই বোন গুটিগুটি পায়ে মঞ্চে ওঠে। ছলছল করছিল চোখ। একবার কেঁদেও ফেলে। নীল রঙের ওড়না দিয়ে চোখ মুছছিল মিতালি। মঞ্চে তাদের পরিচয় করিয়ে দিতে হাততালির ঝড়। দু’জনের হাতে ফুলের তোড়া, বই, মেমেন্টো তুলে দেন রানাঘাটের মহকুমার শাসক প্রসেনজিৎ চক্রবর্তী, সাংসদ তাপস মণ্ডল, বিধায়ক সমীর পোদ্দার, রমা বিশ্বাস, রানাঘাট ২ বি ডি ও শিল্পী সিংহ, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি মিতা পোদ্দার-সহ অন্যান্যরা। অনুষ্ঠানে হাজির ছিল ব্লকের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রীরা।

সংবর্ধনা দেওয়া হয় হাজরাপুর বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক সুজিতকুমার হোতা এবং ওই স্কুলের শিক্ষক কমলেশ মজুমদারকেও। সুজিতবাবু বলেন, “নাবালিকার মেয়ের বিয়ে দেবেন না, আমরা প্রতিনিয়ত প্রচার করি। এটা তারই সুফল।”

বিদ্যালয়ের নবম শ্রেনীর ছাত্রী মেঘলা বিশ্বাস ও একাদশ শ্রেনীর ছাত্রী পিয়ালী ঘোষের কথায়, ‘‘ওরা যা করেছে, ঠিক করেছে। কেন এই বয়েসের ওদের বিয়ে দেবে? আমরা সবাইকে বলব, কেউ যেন আঠারো বছর বয়সের আগে বিয়ে না করে। এতে তো মেয়েদেরই ক্ষতি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন