মেয়েদের ‘গোপন কথা’র বাক্স খুলল পুরুলিয়ার স্কুল

পুরুলিয়ার হুড়া ব্লকের গুন্দলুবাড়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মেয়েদের প্রাধান্য এতটাই যে শুধু ওদের কথা ভেবেই রয়েছে ‘গোপন কথা’র বাক্স। খুদে চোখে ধরা পড়া পারিবারিক নির্যাতনও জমা হয় সেখানে।

Advertisement

জয়তী রাহা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৩:২৯
Share:

শিশু সংসদের সঙ্গে প্রধান শিক্ষক প্রতাপ মাহাতো। নিজস্ব চিত্র

মন্ত্রিসভার পাঁচ সদস্যের তিন জনই মেয়ে। ৭৯ জন পড়ুয়ার দেখভাল করতে তাদের উপরেই মূলত ভরসা করে তিন বিঘের ছোট্ট স্কুলটি। পুরুলিয়ার হুড়া ব্লকের গুন্দলুবাড়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মেয়েদের প্রাধান্য এতটাই যে শুধু ওদের কথা ভেবেই রয়েছে ‘গোপন কথা’র বাক্স। খুদে চোখে ধরা পড়া পারিবারিক নির্যাতনও জমা হয় সেখানে। ওদের গোপন চিঠি খুলে পড়েন স্কুলেরই শিক্ষিকা। গুরুত্ব বুঝলে তার সমাধানে যুক্ত হন গ্রাম প্রধান এমনকি, বিডিও-ও। ছেলেদের জন্যও
রয়েছে অভিযোগ-বাক্স। তবে সেখানে স্কুল সংক্রান্ত অভিযোগই মূলত লিখতে বলা হয়েছে। মেয়েদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা কেন? স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রতাপ মাহাতো বলেন, ‘‘বাচ্চা মেয়েগুলো খুব মুখচোরা। ওদের প্রতিবাদী এবং আত্মবিশ্বাসী করতেই এই ভাবনা।’’

Advertisement

২০১৪ সাল থেকে স্কুলে রয়েছে শিশু সংসদ। মাতাশিক্ষা কমিটি, অভিভাবক কমিটি আর খুদেরা বছরের দ্বিতীয় দিনে ওদের নির্বাচন করেন। প্রধানমন্ত্রী অভিরূপ মাহাতো, শিক্ষা ও পরিবেশমন্ত্রী সুস্মিতা চৌধুরী, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিমন্ত্রী প্রীতম মাহাতো, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ময়না বাউড়ি ও খাদ্যমন্ত্রী আশা বাউড়ি। প্রধানমন্ত্রীর অধীনে লন, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অধীনে সর্পগন্ধা, বাসক-সহ ৩৫ রকমের ওষধি গাছ। খাদ্যমন্ত্রী দেখাশোনা করে আনাজের বাগান। সেখানে মরসুমি ফসল ফলিয়ে তা মিড-ডে মিলে ব্যবহার হয়। শিক্ষা ও পরিবেশ মন্ত্রী ফুলের বাগান, ক্রীড়ামন্ত্রীর ফলের বাগান দেখে। প্রধানশিক্ষক জানালেন, এ সব ওষধির ব্যবহারও জানে খুদেরা। জৈব সার ব্যবহার করে বাগানের যত্নে ওদের উৎসাহ দেখার মতো।

প্রায় ১২০ ঘর দিনমজুর পরিবারের বাস এই গ্রামে। তাই স্কুল চলে সকাল ছ’টা থেকে ১২ ঘণ্টা। সকালে শারীরচর্চা, বরাদ্দ ছোলা-মুড়ি। তার পরে শুরু পড়া। বাড়ি যাওয়ার জন্য এক ঘণ্টার বিরতি। মিড-ডে মিলের তালিকায় ভাত, ডাল, তরকারি। মাসে দু’দিন ডিম আর মাংস। বিকেলে বাগান চর্চা, নাচ-গান-আঁকা শেখা, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়াদের বিশেষ ক্লাস। স্কুলেই ধরে রাখা বৃষ্টির জল ওরা থালা-বাসন ও হাত-মুখ ধুতে ব্যবহার করে।

Advertisement

বছর চারেক আগের ভাঙাচোরা স্কুলটির এমন পরিবর্তন এখনও অবিশ্বাস্য ঠেকে স্থানীয় ভক্তরাম মাহাতোর কাছে। তাঁর কথায়, ‘‘এক বিঘে জমিতে ভাঙা একটি বাড়ি ছিল। বাচ্চারা গাছের নীচে বসত। বৃষ্টিতে স্কুল বন্ধ থাকত। ২০১৪ সালে প্রতাপবাবু প্রধানশিক্ষক হয়ে আসার পরেই বদল আসে।’’ গুন্দলুবাড়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের যে কোনও প্রয়োজনে পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন ইউনিসেফ-এর পশ্চিমবঙ্গ ইউনিটের চিফ মহম্মদ মহিউদ্দিন। বিডিও বলছেন, ‘‘ইচ্ছে থাকলে যে উপায় হয়, তার দৃষ্টান্ত এই স্কুল। খেলার মাঠটি ঘিরে দেওয়ার চেষ্টা করছি।’’ পুরুলিয়ার জেলাশাসক অলোকেশপ্রসাদ রায় বলেন, ‘‘জেলার মডেল ওই স্কুল।’’

প্রতি মাসে এ সব কাজের জন্য নিজেদের বেতন থেকে ন্যূনতম চার হাজার টাকা দেন প্রধানশিক্ষক আর অ্যাসিস্ট্যান্ট টিচার রূপালি মাহাতো। এ কাজে তাঁরা পাশে পেয়েছেন হুড়া ব্লকের বিডিও শুভায়ু কাশ্যপীকে। পাশে আছেন গ্রামবাসীরাও, যাঁরা অনেকেই প্রথমে ভুল বুঝেছিলেন প্রতাপবাবুকে। পরে
তাঁরাই স্কুলের জন্য আরও দু’বিঘা জমি দান করেছেন।

যদিও কোনও কৃতিত্ব নিতে নারাজ শিক্ষকেরা। ‘‘ওরা তো আমাদের সন্তানের মতো। টাকার জন্য ওদের কিছুতে যাতে ত্রুটি না হয় সেই চেষ্টাই করি,’’ বললেন প্রতাপবাবু। এর সম্মতিতে মাথা নাড়েন মিতভাষী রূপালিদেবী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement