বুধনদের হাসি যেন এখনও ‘পদ্মপাতায় জল’

অন্য জীবন অন্য যুদ্ধতথ্যে যা-ই ধরা থাক না কেন, সেই জল যেন এই পড়ে যায়, এই পড়ে যায় ভাব। একটা আছে আর একটা নেই।

Advertisement

রবিশঙ্কর দত্ত

ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:৪৩
Share:

বেলপাহাড়িতে তৈরি হচ্ছে বাবুই দড়ি। ছবি: দেবরাজ ঘোষ

আড়াই বছরের নাতনি কৃষ্ণাকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছিলেন বছর পঞ্চাশের বুধন মাহাত। ডালে ভেজানো ভাতের পাশে ডুমো ডুমো আলু ভাজা আর ছোট এক টুকরো ভাজা মাছ। অচেনা গলা শুনে এঁটো হাতেই ঘোমটা ঠেলতে লাগলেন তিনি। আর বললেন, “রাতে জ্বর আসে রোজ রোজ। বুকে ঘড়ঘড় করে।"

Advertisement

ঝাড়গ্রামের শিলদায় যে ইএফআর ক্যাম্পে মাওবাদীরা বড় হামলা চালিয়েছিল, সেখানেই চালু সরকারি এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি শিশুটি। দশ বছর আগের সেই হামলায় দালানের যে-দাওয়ায় রক্ত ফিনকি দিয়ে এসে পড়েছিল, আতঙ্ক মুছে সেখানেই বসে ঠাকুরমা আর নাতনি। ‘‘ধীরে ধীরে জ্বর কমছে কৃষ্ণার,’’ খেতে খেতে নেচে বেড়ানো নাতনিকে দেখালেন বুধন।

এই ঝাড়গ্রামেরই যে-দহিঝুড়িতে পাঁচ-সাতটা গাড়ি আটকে দিয়েছিল আদিবাসী সংগঠন। পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদে উর্দিধারীদের হাঁটিয়ে থানায় ফিরিয়ে নিজেদের শক্তির প্রমাণ দিয়েছিল তারা। সেই রাস্তায় সবুজসাথীর সাইকেলে স্কুলে যাচ্ছে মেয়েরা। স্থানীয় যুবক এখন সেই বাহিনীতেই চাকরি চান। আর ভরা বাজারে আনাজ কিনছেন পুলিশকর্মী। শিলদা বা দহিঝুড়িই শুধু নয়, ঝাড়গ্রামের আদিবাসী পাড়ার অনেক জায়গায় এই রকম বেশ কিছু বদল হয়েছে। সাদা চোখেই ধরা পড়ছে ভয়মুক্ত জীবন।

Advertisement

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

কিন্তু সর্বত্রই এই বদলের ছবিটা যেন ‘পদ্মপাতায় জল’। তথ্যে যা-ই ধরা থাক না কেন, সেই জল যেন এই পড়ে যায়, এই পড়ে যায় ভাব। একটা আছে আর একটা নেই।

কেন এই অনিশ্চয়তা? রুক্ষ লালমাটিতে এই রকম দু’ফোঁটা নিয়েও কেন সংশয়ের এই দুলুনি?

নাতনির জন্য সরকারি চিকিৎসা পেয়ে বুধনের পরিবার উপকৃত। কিন্তু ঝাড়গ্রামে ব্যবস্থা করতে না-পেরে কৃষ্ণার বাবা এখন ঘাটালে থাকেন। চার ঘণ্টার পথ পেরিয়ে সেই উপার্জনের তেমন কিছুই পৌঁছয় না বাড়িতে। বুধনের কথায়, “ছেলে কাজের খোঁজে বাইরে। ওর দাদুর শরীরটা ভাল না। তাই ঘরে বসে থাকে।’’ সরকারের কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্পের কাছে পৌঁছতে পারেননি দিশারি অঞ্চলের এই মাহাতরা। কোথায় সে কাজ, তার খোঁজ নেই এই রকম অনেক পরিবারের কাছে। অথচ ছোট মোড়েও আনাগোনা রয়েছে লটারির টিকিটের টেবিলে। এই টানাটানি থেকে রেহাই পেতে ভাগ্যে ভরসা।

রোজগার নেই। হাতে টাকা না-এলে জীবনের মান যে খুব বদলায় না, তা স্পষ্ট শিমুলপালের রাস্তায় ফণী সিংহের ঘরদোরেই। গোটা পাঁচ-সাত বাচ্চা নিয়ে মা মুরগি উঠোনের ছায়ায় মাটি খুঁড়ছে। নীচে মাটি আর ইট-টালির এই খুপরির এক পাশে সাইকেলের ‘রিম’ ঘুরিয়ে বাবুই ঘাসে পাক দিয়ে দড়ি বানান বছর চল্লিশের ফণী। রাস্তায় সেই দড়ি ছড়িয়ে দিচ্ছেন তাঁর স্ত্রী। এই বাবুই দড়িতেই লক্ষ্মী বাঁধার প্রাণপণ চেষ্টা চলছে ঘরে ঘরে। শুকনো জলা, নেড়া উঠোনে ঘন সবুজ গাছে ঝেঁপে ফুটেছে লাল জবা। দড়ির হিসেবও এক এক জায়গায় এক এক রকম। ফণীর কথায়, “চার পাঁচ কেজি হলে বাজারে যাই। তিন দিনের পরিশ্রমের বিনিময়ে এক থেকে দেড়শো টাকা পাওয়া যায়।’’ ঘরের উল্টো দিকেই ঝাঁপড়া হয়ে মহুল গাছ। লাল পাতা, সবুজ ফল। সেই ফলই শুকোতে দেওয়া পিচের রাস্তার ধার ঘেঁষে। ছোট বাড়িটা ছাপিয়ে মহুয়ার মিষ্টি গন্ধ এসে পড়েছে রাস্তায়। কাজের কথা এড়িয়ে গেলেন ওঁরা। ভরদুপুরে তাই খাওয়ার কথা। লাজুক দম্পতি ঘরের কথা, সামর্থ্যের কথা অল্পেই সারলেন। বললেন, ‘‘সকালে এক বারই তো খাওয়া। দুপুরে আর রান্না নেই। টম্যাটো ছিল।’’

একই ভাবে আতিথেয়তায় নিজেদের ঘর-সংসার আড়াল করে নিলেন চাকাডোবার সনাতন সর্দার। ঘরের সামনে মাটিতে বসা পঞ্চাশোর্ধ্ব বুধনদের হাসি গৃহকর্তাকে ঘিরে খেলছিল গোটা আট দশ ছাগশিশু। মাটির বাড়ির উঁচু ভিত দেখিয়ে বসতে বললেন। দু’টাকার চাল পান? মাথা নাড়লেন, পান। কিন্তু জীবন এগোতে আরও অনেক কিছু লাগে। ভাতের থালায়ও। তার সংস্থান এখনও নেই সর্দার পরিবারের। বাড়ির বাচ্চারা অবশ্য স্কুলে যায়। ১০০ দিনের কাজ? সনাতন বললেন, ‘‘ওই...।’’ দ্রুত প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে রান্নার কড়াই থেকে জল গড়িয়ে দুপুর রোদে দাওয়ায় আসা অপরিচিতকে এগিয়ে দিলেন গৃহকর্ত্রী। কে থাকে সরকারের দেওয়া টাকায় তৈরি বাড়িতে? একেবারে কেউ-ই যে পাননি, তা নয়। চোখে পড়েছে, ‘আমার বাড়ি প্রকল্প’, উপভোক্তার নাম ইত্যাদি। তবে তা যে প্রয়োজনের তুলনায় কম, তা সাদাচোখেই স্পষ্ট। সরকারের দেওয়া চাল, কাজ যায় কোথায়? সে প্রশ্নের উত্তরও অজানা নয় এ অঞ্চলে।

সব অভাব দূর হবে, এ ধারণা বাস্তব নয় ঠিকই। রুক্ষ জঙ্গলমহলে তার কল্পনাও কষ্টকর। কিন্তু সরকারের ঘর থেকে আসা আদিবাসী পাড়ার সুবিধার বেশিরভাগই যে রাস্তায় হারিয়ে যায়, ঝাড়খণ্ড লাগোয়া শিমূলপাল পর্যন্ত তার প্রমাণ ভুরি ভুরি। সে কথাই বলছিলেন কাকরাঝোড় প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক সূর্যকান্ত মণ্ডল। বেলদার তরুণ তাঁর স্কুলের পাশে ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন দশ বছর ধরে। বাড়ি যান স্কুল ছুটির অনেক পরে। বলছিলেন, “এখানকার মানুষ খুব ভাল। টেনে ধরে করিয়ে নিতে হবে।’’ সে ভাবেই এখনও স্কুলে জনা তিরিশ ছাত্রছাত্রী ধরে রেখেছেন তিনি। আদিবাসী পাড়ার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এইরকম লড়াই চলছে ওদলচূয়া অঞ্চলের কোদপুড়া স্কুলে। এই অঞ্চলে সাওতালি শিক্ষায় প্রাধান্য দিতে বাংলা মাধ্যমের বিভাগটি এখান থেকে সরিয়ে নিয়েছে শিক্ষা দফতর। কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। এক সময়ের বিশাল স্কুল বাড়ির একটা বড় অংশই এখন অব্যবহৃত পড়ে রয়েছে। ২৪ টি বাচ্চা স্কুলেরই হস্টেলে থাকে। পঞ্চাশ বছরের পুরনো স্কুলে প্রধান শিক্ষক যজ্ঞেশ্বর সাউ কাটিয়ে ফেলেছেন ৩৫ বছর। ডিসেম্বরে তাঁর অবসর। বললেন, ‘‘কয়েকটা কাজ করা খুব দরকার।’’

দুপুরের রোদে জ্বলতে থাকা রাস্তা, জঙ্গল আর পাড়াগুলোয় বিকালে লাল-ভাব গাঢ়। দলমার পিছনে ডুবতে থাকা নরম সূর্যের সামনে স্কুলফেরত ‘কন্যাশ্রী’ সাইকেল থামিয়ে গল্প করে সময়বয়সী কিশোরের সঙ্গে।

আবার বুড়িঝোড়ের রাস্তায় সেই আলোতেই দেখা ছুটে বেড়ায় জওয়ানদের বাইক। তাঁদের হাতের খোলা এসএলআর।

অতীত মনে পড়ে এই ঝাঁকুনিতে। যেন দুলে যায় বদলের সেই ছবিটা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন