ছবি: এপি।
বাঁধের উপরে ভাঙা রাস্তায় দুলতে দুলতে চলেছে প্রার্থীর ছোট কনভয়। একটু দূর থেকে কচিকণ্ঠে ভেসে আসছে চিলচিৎকার— ‘জয় শ্রীরাম’!
বাচ্চাদের মুখেও ‘জয় শ্রীরাম’! মালদহের প্রত্যন্ত গ্রামেও ‘রামায়ণ’? প্রথম ধাক্কায় তেমনই মনে হয়েছিল বটে। তবে একটু তলিয়ে দেখলে মনে হচ্ছে, এ বারের গৌড়বঙ্গে আসলে এক খণ্ড ‘মহাভারত’ চলছে!
স্বজনের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিতে পুরাণের অর্জুন যখন দ্বিধাগ্রস্ত, তাঁকে কৃষ্ণ ধর্ম-শিক্ষা দিয়েছিলেন।বলেছিলেন, জয় ন্যায়ের হবে। সে নিয়তি ঠিক হয়েও আছে। অর্জুন তো নিমিত্ত শুধু।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
এই গৌড়ের গাজোলের চাকনগরে প্রত্যন্ত গ্রামে বিজেপি প্রার্থীকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘‘আমি খগেন মুর্মু নিমিত্ত মাত্র। লড়াইটা দেশরক্ষার। আমার নয়, নরেন্দ্র মোদীর মুখ মনে করে ভোটটা দেবেন।’’
হরিশ্চন্দ্রপুরে খোপাকাঠি পঞ্চায়েতের রাস্তায় প্রতিমার শোভাযাত্রার মতো ঘুরছে হুডখোলা গাড়ি। তার পিঠে জোড় হাতে ঠাকুরের মতো দাঁড়িয়ে মৌসম বেনজির নূর। শোভাযাত্রা থামলে তৃণমূল প্রার্থী বলছেন, ‘‘সাম্প্রদায়িক শক্তিকে হারাতে চাই। দিদির হাত ধরে উন্নয়নের কাজে সামিল হতে চাই।’’ আগের দু’টো ভোট তাঁর কেটেছে মামা-মামা করে, এ বার দিদি-দিদি। শাসক দলে যোগ দেওয়ার সুবাদে স্বভাবতই প্রচারে জৌলুসও বেড়েছে।
কেন্দ্র এক নজরে মালদহ উত্তর
• ভোটার: ১৬ লক্ষ ৮১ হাজার ৭৮২
• ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে জয়ী কংগ্রেসের মৌসম বেনজির নূর। জয়ের ব্যবধান ৬৫ হাজার ৭০৫।
• ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফলের নিরিখে এগিয়ে কংগ্রেস-বাম জোট। মোট ৭টি বিধানসভার মধ্যে ৪টিতে কংগ্রেস, ২টিতে সিপিএম এবং ১টিতে বাম ও কংগ্রেস সমর্থিত নির্দল জয়ী।
ভালুকার দৌলতপুরে চরে বেড়াচ্ছে কংগ্রেস প্রার্থীর জিপ। গ্রামে গ্রামে নেমে ঈশা খান চৌধুরী বলছেন, ‘‘বিজেপি অন্যায় করছে, হিন্দু-মুসলিমে ভাগাভাগি করছে। রাহুল গাঁধী ‘ন্যায়’ আনবেন। তাঁর জন্য ভোট দিন, হাত শক্ত করুন।’’
অর্থাৎ? সবই নিমিত্ত! কেউ মোদীর, কেউ দিদির, কেউ রাহুলের নিমিত্ত হয়ে ময়দানে নেমেছেন। এবং ন্যায়ের লক্ষ্যে পৌঁছনোর এই যুদ্ধক্ষেত্র স্বজন, আপন জনের বিরুদ্ধেও দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তাঁদের।
কী রকম? কংগ্রেসের ঈশা আর তৃণমূলের মৌসম, দুই প্রার্থী পারিবারিক সম্পর্কে মামাতো-পিসতুতো ভাই-বোন। ঈশা তিন বছর আগে বিধানসভা ভোটে তাঁর লেবুচাচাকে (আবু নাসেম খান চৌধুরী) হারিয়ে এসেছিলেন। এ বার আরও বড় পরিসরে স্বজনের বিরুদ্ধে আয়ুধ হাতে নেওয়ার পালা! যে পালার দিকে ইঙ্গিত করে খগেন বলতে পারছেন, ‘‘ওদের কাউকে যদি ভোট দেন, তা হলে হয় পিসি-ভাইপোর পরিবার নয়তো কোতুয়ালির (প্রয়াত বরকত গনিখানের বাড়ি) পরিবার ক্ষমতা পাবে। এই পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক বার রায় দিন!’’
খগেন নিজেও এই সে দিন পর্যন্ত যাদের স্বজন মনে করতেন, এখন তাদের আমানত ভাঙানোর দিকেই তাঁর নজর! পাঁচ বছর আগে কংগ্রেসের মৌসমের বিরুদ্ধে সিপিএম প্রার্থী খগেন তিন লক্ষ ২২ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। এ বার গেরুয়া পাঞ্জাবি গায়ে চড়িয়ে দাবি করছেন, ‘‘ওই ভোটের অন্তত ৫০% আমাদের (বিজেপি) দিকে চলে আসবে।’’ ঘটনা যে, গাজোল, হবিবপুর, মালদহ (পুরনো) বিধানসভায় তৃণমূলের মূল লড়াই এ বার বিজেপির সঙ্গেই। কিন্তু সংখ্যালঘু-প্রধান এলাকায় ঢুকলে দৃশ্যত অন্তত বিজেপির তেমন হইচই নেই। ধর্মগত পরিচয়ের দৃষ্টিভঙ্গি এ বার বেশ সামনে উঠে এসেছে।
বিশেষ হইচই ছাড়াই প্রবীণ বয়সে উত্তর মালদহের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত দৌড়চ্ছেন আরও এক জন। প্রচারের আলো তাঁর উপরে নেই। কিন্তু অনেকটা ‘যে পক্ষের পরাজয়, সে পক্ষ ত্যজিতে মোরে করো না আহ্বান’-এর ভঙ্গিতে হাসিমুখে পরিশ্রম করছেন বিশ্বনাথ ঘোষ। বামেদের ভোটব্যাঙ্ক নামক কবচ-কুণ্ডলটা যদি সিপিএম প্রার্থী অক্ষত রেখে দিতে পারেন, তবে খগেনের রথের চাকা বসে যাওয়া আশ্চর্য নয়! মালতীপুরের অচিনতলা হাটে দাঁড়িয়ে বিশ্বনাথবাবু বলছেন, ‘‘কোনও প্রার্থী বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়। লড়াই নীতির। তরুণদের চাকরি নেই, মানুষের কথা বলার অধিকার নেই। মানুষকে বলছি, পরিস্থিতি বদলের জন্য ভোট দিন।’’ এই ফাঁকে উল্লেখ করা থাক, মহাভারতে কর্ণ যেমন শিবির না বদলে জেনেশুনে পরাজয় বরণ করেছিলেন, মালদহে আবার শিবির বদলে জনগণেশের স্নেহচ্ছায়া বেশি দিন মেলেনি কারও। গৌতম চক্রবর্তী, কৃষ্ণেন্দু চৌধুরী, সাবিত্রী মিত্র, সুশীল রায়, তাজমুল হোসেন— দল বদলে জনজীবনে ধীরে ধীরে পিছিয়ে যেতে হয়েছে, এমন তালিকা বেশ লম্বা। এবং এ বারেও দলবদল ঘিরে মালদহে বেশ ভালই কানাকানি।
চর্চা আছে আরও এক বিষয়েও। আগেকার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ঐতিহ্য ভেঙে গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে নিজের ভোট কেন দিতে পারলাম না, এই প্রশ্ন শহরে-গ্রামে ঘুরছে বিস্তর।
এখন প্রশ্ন হল, এই ধর্মযুদ্ধে নিয়তি কোন দিকে? কৃষ্ণই বা কোন নিমিত্তের পক্ষে? তাঁর সুদর্শনচক্র ভোটারের আঙুলে নেমে ভোটযন্ত্রে যেমন ভাবে সঞ্চালিত হবে, উত্তর জানা যাবে তখনই!