ট্রেনেও এখন আলোচনার বিষয় ভোটের ফলাফল। ফাইল চিত্র
অকালে বিরলকেশ যুবকের এই ‘সম্ভাষণ’ ঠিক পছন্দ নয়। তবু রানাঘাট স্টেশনে নির্দিষ্ট কামরায় উঠতেই ‘আজ তো তোমার দিন অমিত শাহ’— ডাকাডাকিই তাঁর চার দিক ঘিরে স্বাগত জানাল।
সোমবার সকালে শিয়ালদহমুখী কৃষ্ণনগর লোকাল। সদ্য লোকসভা ভোট-উত্তর দেশের গেরস্ত জীবনের প্রাত্যহিকতার নয়া সূচনা। লোকাল ট্রেনের গোবেচারা ‘অমিত শাহ’-কে ঘিরেই অফিসটাইমের মৌতাত ঘন হচ্ছে। হাতের টাটকা খবরের কাগজে যাবতীয় বুথ ফেরত সমীক্ষার হিসেব হাতে নিয়ে নিত্যযাত্রীরা ওই যুবককে কার্যত ছেঁকে ধরলেন। ‘তুমি ২৩টা বলেছিলে, ওরা ১৬ বলছে! আরও ক’টা বাড়বে না কি গুরু?’ রানাঘাটের ‘অমিত শাহ’-এর থেকে বয়সে ঢের বড় প্রৌঢ়রা অবধি পা টানাটানিতে কম যাচ্ছেন না।
‘একটু মিছরির জল খাও, এত গ্যাস সহ্য হবে তো!’ কিংবা ‘বিজেপি ১০টা সিট পেলেই ঝুঁকে থাকা নেতারা লাফিয়ে বেড়া টপকাবেন’ গোছের রসিকতা উড়ে বেড়াচ্ছে চলন্ত কামরায়। ‘ধুর, ধুর সমীক্ষা না ছাই, কাউন্টিংয়ের আগে মহাগঠবন্ধন-কে ঘেঁটে দেওয়ার চাল।’ গর্জে ওঠা মন্তব্যটা হাসির হররায় চাপা পড়ে গেল।
বুথ ফেরত সমীক্ষা-উত্তর জনমানসের একটি চিত্র, লোকাল ট্রেনের পটভূমিতে। সমীক্ষায় বাংলার জমি শক্ত করে দেশে বিজেপি-র উত্থানের ইঙ্গিতে যাঁরা খুশি হয়েছেন, স্বভাবতই তাঁদের মুখে এখন খই ফুটছে। তবু সমীক্ষা যা বলছে, তাকে বেদবাক্য ধরে নিচ্ছে জনতা, ঠিক তা-ও বলা যায় না। কৃষ্ণনগর, ডানকুনি, ডায়মন্ড হারবার বা হাসনাবাদ লোকালের বিভিন্ন নিত্যযাত্রীর আলোচনায় মোদীর দিল্লিতে ‘ফেরা’ নিয়ে জল্পনার সুর। ব্যান্ডেল লোকালে মোদী-ভক্ত কয়েক জন প্রবীণ ‘চৌকিদার চোর’ বলা ঠিক হয়নি বলে বাকিদের ঈষৎ বকাবকি করে নিলেন। তবে সামগ্রিক ভাবে রাজ্যে তৃণমূলের ক’টা সিট কমবে-র চর্চাই আলোচনার মূল ঝোঁক। কেউ বলছেন, বুথ-ফেরত সমীক্ষা ২০০৪, ২০০৯ বা গেল বিধানসভা ভোটেও ফেল মেরেছিল। বিরুদ্ধ-যুক্তি আবার ২০১১ বা ২০১৪-য় সমীক্ষার সাফল্য মেলে ধরছে।
দুপুরের ঈষৎ ফাঁকা শহুরে মেট্রোরেলেও এ দিন বেশ উচ্চ গ্রামে আলোচনা কানে এল। দমদম থেকে ওঠা দিদিভক্ত প্রৌঢ় এখনও বলছেন, বিজেপি এক থেকে বড়জোর পাঁচ হবে, তার বেশি হতেই পারে না! একটি সমীক্ষা আবার বিজেপি-জোটকে সব মিলিয়ে ৩৩৪টি দিলেও বাংলায় পাঁচটির বেশি দিচ্ছে না, গলা ফুলিয়ে সহযাত্রীদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন তিনি।
তবু ওই জটলায় কান পাতলেও, প্রচ্ছন্ন হতাশার সুর গোপন থাকে না! তবে মমতা নয়, তাঁরা পড়েছেন রাহুল গাঁধীকে নিয়ে। বিজেপি-বিরোধী ভোট জড়ো করতে উত্তরপ্রদেশে কেন মায়াবতী-মুলায়মের সঙ্গে জোট বাঁধতে পারলেন না রাহুল? কিংবা সিপিএমের জায়গা কেরলে দাঁড়িয়ে কী লাভ হল? হিসেব কষছেন মেট্রোযাত্রী মধ্যবিত্ত! তিনি রাজনীতি করেন দাবি করে মুখ খুললেন ক্ষয়াটে চেহারার প্রৌঢ়। ‘‘প্রিয়ঙ্কা গাঁধীরও মোদীর বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়ানো উচিত ছিল। হারলে, হারতেন! কিন্তু একটা বার্তা যেত! প্রিয়ঙ্কার সাহসেই অন্যত্র কংগ্রেসের সিট বাড়ত।’’
ট্রেনের কামরা মানেই রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ছড়াছড়ি। তবু রসিকতার সুরটাই প্রধান। ডানকুনি লোকাল দক্ষিণেশ্বরে ঢুকতেই স্থানীয় এক তরুণকে ‘মদনদা এসো’ অভ্যর্থনা ছুড়ে দেওয়া হল। তাঁর নাম আসলে মদন নয়, তবে মদন মিত্রের পূর্ববর্তী বিধানসভা কেন্দ্র কামারহাটির তিনি বাসিন্দা। ‘কী মদনদা, তোমার কী হবে’ গোছের ঠাট্টায় সেই ব্যক্তি ‘জয় শ্রীরাম’ বলে উঠলেন। ‘‘ওরেব্বাস, তুমিও জয় শ্রীরাম’’— কোরাসে সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনের কামরা ফের সরগরম।
বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ হাসনাবাদ লোকালে আরও একটু আক্ষেপের সুরও কিন্তু শোনা গিয়েছে। বুথ ফেরত সমীক্ষার ইঙ্গিত অনুযায়ী, বামেরা শুধু যে একটি সিটও পাবে না এমন নয়, তাদের ভোটের হার পাঁচ শতাংশে নেমে আসতে পারে! ‘সব বাম কি শেষে রাম হয়ে গেল’ কিংবা ‘আর কতটা ধস নামবে লালেদের’ থেকে ক্ষীণ আশা, ‘বিকাশ ভট্টাচার্যও কি জিতবেন না!’
তৃণমূল-বিজেপি নিয়ে তুমুল কাটাছেঁড়ার আবহে বামেরা এখনও লোকাল ট্রেনের আলোচনায় একেবারেই হারিয়ে যাননি!