রামনবমীতে দিলীপ ঘোষ। খড়্গপুরে। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।
অন্যান্য রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা, প্রশাসনের আপত্তি, এমনকি, সঙ্ঘ পরিবারের আবেদন— সব কিছু উপেক্ষা করে নিজের জেদে অটল থাকলেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি তথা মেদিনীপুর লোকসভা কেন্দ্রে দলের প্রার্থী দিলীপ ঘোষ। গত বারের মতো এ বারেও অস্ত্র হাতেই রামনবমী পালন করলেন তিনি। এবং প্রয়োজনে সেই অস্ত্র কারও কারও বিরুদ্ধে ব্যবহার করার হুমকিও দিলেন। বস্তুত, রাজ্যের বিভিন্ন জায়গাতেই শনিবার অস্ত্র সমেত রামনবমীর মিছিল হয়েছে।
যার কড়া নিন্দা করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেন, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে। ধর্মের নামে কেউ কেউ সমাজকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করছেন। এতে লোকসভা ভোটের পর্বে নির্বাচনী বিধি ভঙ্গ হচ্ছে।
শিলিগুড়ির বাঘা যতীন পার্কে দার্জিলিঙের তৃণমূল প্রার্থী অমর সিংহ রাইয়ের সমর্থনে নির্বাচনী জনসভায় মমতা বক্তৃতা শুরুই করেন রামনবমীর প্রসঙ্গ দিয়ে। তিনি বলেন, ‘‘কিছু রাজনৈতিক দল আফিম খাইয়ে লোককে ঘুম পাড়িয়ে রাখার মতো মিথ্যে ধর্মের আমদানি করেছে। তার নামে একে অন্যের উপর অত্যাচার করছে। সেই ধর্মের সঙ্গে হিন্দু, মুসলিম, শিখ, জৈন কোনও ধর্মের সম্পর্ক নেই।’’ এই প্রেক্ষিতেই মমতার মন্তব্য, ‘‘ধর্ম বেচে খাবেন না। ধর্মকে আমরা সম্মান করি। ধর্মকে নিয়ে আমরা রাজনীতি করতে নামি না।’’
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
নির্বাচনী বিধি চালু থাকা সত্ত্বেও কী ভাবে অস্ত্র হাতে রামনবমীর মিছিল হচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, ‘‘নির্বাচনের কতগুলি নিয়ম আছে। যাতে নির্বাচনী বিধি না ভাঙে, সেটা আমিও নজর রাখি। আর কেউ কেউ গদা নিয়ে, তরবারি নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে ভোট চাইতে। রাজনীতির সঙ্গে এর কী সম্পর্ক? গদা দিয়ে কার মাথা ফাটাবেন? তরবারি দিয়ে কার গলা কাটবেন? বাংলায় এ সব করে ভোট হয় না।’’ মমতার সংযোজন, ‘‘যারা ত্যাগ করবে, তারাই গেরুয়া পরবে। এরা কারা? বাইরে গেরুয়া ভেতরে কালো?’’ আরএসএস সম্পর্কে ছড়া কেটে তিনি বলেন, ‘‘কয়েকটা আরএসএসের পাণ্ডা, হাতে নিয়েছে বড় বড় ডান্ডা, আর সঙ্গে জুটিয়েছে কয়েকটি গুন্ডা, এই নিয়ে দেশকে করছে ঠান্ডা।’’ মানুষকে সতর্ক করে মমতা বলেন, ‘‘আরএসএস দেখলেই খেয়াল রাখবেন। এরা বড় ভয়ঙ্কর।’’ দিলীপবাবুর সশস্ত্র মিছিলের পরেও নির্বাচন কমিশন তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন, সেই প্রশ্ন তোলেন তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়।
দিলীপবাবু অবশ্য মমতার বক্তব্যের জবাবে বলেছেন, ‘‘রাজ্যের সুস্থ সংস্কৃতিকে যারা কলুষিত করছে, হিংসার প্লাবন বইয়ে দিচ্ছে, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করছে, মা-বোনেদের সম্মানহানি করছে, দরকার হলে গদা-তরোয়াল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করব।’’ দিলীপের আরও ব্যাখ্যা, “অস্ত্র নিয়ে রাস্তায় ঘোরাফেরা করা, ভয় দেখানো বেআইনি। কিন্তু আখড়ার অস্ত্রের লাইসেন্স রয়েছে। খালি রসগোল্লা খাব, আর হাতিয়ার ধরব না, সেটা হয় না।”
বিশ্ব হিন্দু পরিষদ অবশ্য আগেই জানিয়েছিল, তারা অস্ত্র নিয়ে রামনবমীর মিছিল করবে না। এ দিন দিলীপবাবুর অস্ত্র নেওয়ারও দায় নিতে চায়নি পরিষদ। তাদের পূর্ব ক্ষেত্রের সংগঠন সম্পাদক শচীন্দ্রনাথ সিংহ বলেন, ‘‘দিলীপবাবু যে মিছিলে গিয়েছিলেন, সেটা আমাদের নয়। একটি আখড়ার। আমরা কোথাও রামনবমীর অনুষ্ঠানে অস্ত্র নিইনি।’’
পুরুলিয়া, বর্ধমান, হুগলি এবং পূর্ব মেদিনীপুরেও এ দিন রামনবমী উদ্যাপন হয়। ওই জেলাগুলির বেশ কয়েক জায়গায় রামনবমীর অনুষ্ঠানে অস্ত্র ছিল বলে অভিযোগ। শুধু বিজেপি নয়, তৃণমূলও এ দিন রাম পুজো করেছে। বিভিন্ন জেলায় সেই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন তৃণমূলের প্রার্থী এবং কাউন্সিলররা। যেমন— কাঁথির বিদায়ী সাংসদ এবং ওই কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী দিব্যেন্দু অধিকারী মেচেদা বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন একটি মাঠে রামনবমীর যজ্ঞ ও রামকথার অনুষ্ঠানে যোগ দেন। তিনি বলেন, ‘‘রাম কারও একার নয়।’’ দুর্গাপুরের পলাশডিহায় রামনবমীর অনুষ্ঠানে যান বর্ধমান-দুর্গাপুর কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী মমতাজ সংঘমিতা। কাঁথি পুরসভার চেয়ারম্যান এবং একটি রামনবমী উদ্যাপন কমিটির সভাপতি সৌম্যেন্দু অধিকারীর আয়োজিত রামনবমীর অনুষ্ঠানে আজ, রবিবার যাওয়ার কথা পরিবহণ মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীর। শুক্রবার রাতে বর্ধমান শহরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডে রাম পুজোয় হাজির ছিলেন তৃণমূল নেতারা। উত্তরপাড়া-কোতরং পুরসভার চারটি ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলররা এ দিন রামনবমী উপলক্ষে ‘কলস যাত্রা’ করেন।
বর্ধমানে রামনবমীর মিছিলে অস্ত্র হাতে শিশুদেরও দেখা গিয়েছে। পুলিশ সূত্রের খবর, স্থানীয় একটি হনুমান মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত কিছু বাসিন্দা ওই মিছিল করেছেন। তবে তাঁদের সঙ্গে বিজেপি এবং তৃণমূলের যোগ নেই বলে দাবি করেছে দুই দলই। পূর্ব বর্ধমানের জেলাশাসক অনুরাগ শ্রীবাস্তব বলেন, “বিষয়টি আমার জানা নেই। এ নিয়ে রিপোর্ট চাইব।’’
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী এ দিন বলেন, ‘‘ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মেতে উঠে সাম্প্রদায়িকতার মোকাবিলা করা যায় না। তৃণমূল আর বিজেপির গড়াপেটা, যা আমরা বার বার বলছিলাম, তা আবার স্পষ্ট হল।’’ রামনবমী নিয়ে উন্মাদনার প্রতিবাদ করে নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হচ্ছে ‘সেভ ডেমোক্র্যাসি’।
দিল্লি যাওয়ার আগে রাম নবমী প্রসঙ্গে রাজ্যের বিশেষ পুলিশ পর্যবেক্ষর বিবেক দুবে বলেন, ‘‘জেলা প্রশাসন রামনবমীর প্রস্তুতি দেখবে। আমি নির্বাচন নিয়ে বেশি আগ্রহী।”
রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের দফতর সূত্রের খবর, রামনবমী কর্মসূচির কোনও বিজ্ঞাপনে প্রার্থীদের ছবি দেখা গেলে তার রিপোর্ট দেবেন জেলার নির্বাচনী অফিসারেরা। তার পরে তা খতিয়ে দেখবে কমিশন।