গরম হাওয়া অথবা নিছক শসার গল্প

বাদুরিয়া লাগোয়া এই আড্ডাখানা হাবে-ভাবে কলকাতা কফি হাউস। নানা পেশার মধ্যবিত্ত চায়ের কাপে রাজনীতির তুফান তোলেন।

Advertisement

স্যমন্তক ঘোষ 

বসিরহাট শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৯ ০৩:২৬
Share:

আকাশ গুমোট। প্রবল ঝড়ের আশঙ্কায় থমথমে আবহ।

Advertisement

‘‘ফণী, ফণী। বসিরহাটের ভোটেও এ বার ঝড় উঠবে। মানুষের চোখে মুখে থমথমে ভাব দেখছেন না?’’ মাস্টারমশাই কুন্তল চক্রবর্তী কথাটা বলতেই সমস্বরে ঝগড়া জুড়লেন হাজি সফিকুল, সাইখুল ইসলামরা। ‘‘ঝড়ের পূর্বাভাস আছে। তবে শেষ পর্যন্ত তা বাংলাদেশের দিকে ঘুরে যাবে। ভোট অঙ্কে হয়, ভায়া।’’ সংলাপে ঢুকলেন সাইখুল।

বাদুরিয়া লাগোয়া এই আড্ডাখানা হাবে-ভাবে কলকাতা কফি হাউস। নানা পেশার মধ্যবিত্ত চায়ের কাপে রাজনীতির তুফান তোলেন। লড়াই হয়। হাওয়া ঠান্ডা হলে সকলেই চায়ের পয়সা বাড়িয়ে দেন। সেই তাঁরাও ইদানীং ভেবে কথা বলছেন। ‘ঘটনা’টা ঘটে যাওয়ার পর।

Advertisement

‘‘বাদুরিয়া হিংসার ক্ষত এখনও তাড়া করছে। সে বসিরহাট আর নেই।’’ উসকোখুসকো চুলে আঙুল চালিয়ে মাথা ঝোঁকালেন কুন্তল। আড্ডাখানার এই বন্ধুরাই তখন পাড়ায় পাড়ায় শান্তি মিছিল বের করতেন। রাত জাগতেন দিনের পর দিন।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

‘‘ওই সময় রাজনীতির ভূমিকা খুব ভাল ছিল না। সব দল যদি এক সঙ্গে হিংসার বিরুদ্ধে ময়দানে নামত, জল এত দূর গড়াত না। কিন্তু কোনও কোনও দল সেখান থেকেও রাজনীতির সুদ তোলার চেষ্টা করেছিল। বসিরহাট তার খেসারত দিচ্ছে।’’ উত্তেজিত হলেন সফিকুল।

দীর্ঘদিন ধরে পাশাপাশি বাস করা দুই ধর্মের মানুষের মধ্যে কোথাও যে একটা ‘অস্বস্তি’ আছে, বসিরহাটের আনাচ-কানাচে তার আভাস মেলে। সেটাই মেরুকরণের রাজনীতির উৎস।

‘‘দ্যাখেন, বাঁচতি হবে। গেরুয়া পার্টি এলে ভিটে-মাটি ছাড়তি হবে বলছে। তৃণমূলের উপর রাগ থাকলেও ভোট এ বার ওই প্রতীকেই যাবে।’’ উত্তর বসিরহাটে বিকেলের নমাজের রোদ মেখে চায়ের দোকানে খোলামেলা বলে দিলেন বৃদ্ধ। নাম লেখা যাবে না, এই শর্তে। হিংসায়, প্রতিবেশী হারিয়েছেন তিনি।

বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রের বিস্তার ভয়াবহ। রাজারহাট-নিউটাউনের গা ধরে পৌঁছে যায় সুন্দরবনে। জল-জঙ্গলের সন্দেশখালি আর হিঙ্গলগঞ্জের একটা অংশ বাদ দিলে, বাকি বসিরহাটে ‘অবিশ্বাসের’ বাতাবরণ। ফলে বসিরহাট উত্তরের এক মেরুর আশঙ্কা একই কম্পনে প্রতিফলিত হয় বাদুড়িয়ায় অন্য মেরুর গলায়। তারা বিজেপি চায়।

মেরুকরণের সেই অঙ্কেই সীমান্তবর্তী লোকসভায় ‘ফণী’র আশা দেখছে পদ্মফুল। বিজেপির প্রার্থী সায়ন্তন বসু স্পষ্টই বলছেন, মেরুকরণের ফলে এক সম্প্রদায়ের মানুষ তাঁকে ভোট দেবেন না, এটা ধরে নিলেও, অন্য সম্প্রদায়ের সিংহভাগ ভোট তাঁর ঝুলিতে ঢুকবে। চতুর্মুখী লড়াইয়ে তাঁর দরকার ৪০ শতাংশ ভোট। সায়ন্তনের দাবি, ‘‘পঞ্চায়েত ভোটে সন্ত্রাসের জন্য তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোটেও ভাঙন ধরবে।’’

বিজেপি প্রার্থীকে মনে করিয়ে দেওয়া গেল, এই লোকসভারই দক্ষিণ বসিরহাট বিধানসভা কেন্দ্রে ২০১৫ সালে শমীক ভট্টাচার্য ১৭০০ ভোটে জিতেছিলেন। ২০১৬-তে সেই শমীকই ২৪০০০ ভোটে হেরেছিলেন। ভোটের অঙ্ক ‘সরল’ নয়।

দিল্লি থেকে বসিরহাট পৌঁছে প্রথম দর্শনেই মেরুকরণের গন্ধটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল বামফ্রন্ট সমর্থিত সিপিআই প্রার্থী পল্লব সেনগুপ্তের কাছে। ছোট ছোট স্ট্রিট কর্নারে তিনি তাই সংক্ষেপে বসিরহাটের সম্প্রীতির ইতিহাস শোনাচ্ছেন। তাঁর সভায় ভিড় হচ্ছে না বললে সত্যের অপলাপ হবে। তবে ভিড় উপচেও পড়ছেন না। মেরুকরণের ভোটে যে বামেদের লাভ নেই, সে কথা মানেন পল্লববাবু। তবে একই সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘‘মেরুকরণের কথা তো বলতে পারব না। বিশ্বাস করি, মানুষ স্বভাবত সম্প্রীতির পক্ষে। ফলাফল জবাব দেবে।’’ পল্লববাবুকে মনে করিয়ে দেওয়া গেল, তেভাগা দেখা বসিরহাট একদা বাম-দুর্গ ছিল।

ওড়িশায় আছড়ে পড়লেও বাংলায় সে ভাবে ঢোকেনি ফণী।

তৃণমূল প্রার্থী নুসরত জহান বিশ্বাসই করতে চাইলেন না, ফণীর আদৌ আসার কথা ছিল বসিরহাটে। ‘মেরুকরণ’ শব্দটাতেই তাঁর আপত্তি। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, ‘‘কিছু লোক এ সব রটাচ্ছে। হিংসার স্মৃতি উসকে দিয়ে ভোটের রাজনীতি করছে। উপর উপর ঘুরলে আপনারও মনে হবে আবহাওয়া গুমোট। কষ্ট করে একটু ভিতরে ঢুকুন। গ্রামগুলোয় যান। দেখবেন, কোথাও কোনও গোলমাল নেই। মানুষ উন্নয়ন বোঝেন। বিপুল ভোটে আমি নয়, দিদি জিতবেন।’’

নুসরতের গলায় বিশ্বাস স্পষ্ট। তাঁকে মনে করিয়ে দেওয়া গেল, বিরোধীরা প্রকাশ্যে প্রচার করছেন, ‘তিন তালাক’ নিয়ে অভিনেত্রীর মন্তব্য সংখ্যালঘু ভোটে ভাঙন ধরিয়েছে। ড্যামেজ কন্ট্রোলে মুখ্যমন্ত্রীকেও এ বিষয়ে মন্তব্য করতে হয়েছে।

পাল্টা মন্তব্য না করে বিতর্ক এড়ালেন নুসরত। একটিই শব্দ ব্যবহার করলেন— ‘অপপ্রচার’।

বসিরহাট দক্ষিণের ফুটবলার বিধায়ক দীপেন্দু বিশ্বাসও নুসরতের সঙ্গে সহমত। কিছু লোক অপপ্রচারের চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু ‘উন্নয়নে’র কাছে হেরে যাবে।

‘‘বাস্তব সততই সুখের নয়।’’ জমিদারি ঢঙে সংলাপে ঢুকলেন কাজি আব্দুর রহিম, ওরফে দিলুদা। মালদহ কোতোয়ালির রাজপ্রাসাদ না হলেও দিলুদার বাড়ি নেহাত ফেলনা নয়। অধুনা বাদুড়িয়ার কংগ্রেস বিধায়ক বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রের একমাত্র ভূমিপুত্র। তাঁর বাবা ছিলেন গফ্ফর সাহেব। পুরনো কংগ্রেসি। এলাকার মানুষ ভালবেসে ডাকতেন ‘সীমান্ত গাঁধী’।

নুসরতের কথাকে সম্পূর্ণ সম্মান জানিয়ে দিলুদার বক্তব্য, ‘‘দুঃখজনক হলেও বসিরহাটে মেরুকরণ হয়েছে, এটা সত্য। আর তার চেয়েও বড় সত্য, পঞ্চায়েত নির্বাচনে শাসকের সন্ত্রাস। তৃণমূলের ভোট ভাঙবে এবং সেটা আমার পক্ষেই আসবে।’’

দিলুদার চিত্রনাট্য সিনেমার মতোই। প্রার্থী ‘অপছন্দ’ আর পঞ্চায়েতে ‘হাঙ্গামা’, এই দুই কারণে বসিরহাটের সংখ্যালঘু ভোটের একটা অংশ কংগ্রেসে ফিরবে। অন্য দিকে চিরকালীন কংগ্রেস ভোটও থাকবে ভূমিপুত্রের সঙ্গে। ফলে ভোট কাটাকাটিতে ২০১৪ সালে রায়গঞ্জে বামেরা যে ফসল তুলেছিল, এ বার বসিরহাটে সে ফল পাবে কংগ্রেস।

দিলুদাকে মনে করিয়ে দেওয়া গেল, বামেদের দাবি, তাদের ভোটেই বাদুড়িয়ায় বিধায়ক হয়েছেন তিনি।

বিরোধীদের কথা শুনে হাসতে হাসতে চেয়ারে গড়িয়ে পড়লেন নাতিদীর্ঘ বাবুমাস্টার। ‘‘শুনুন, দু’দিন ব্যায়াম করে কেউ যদি নিজেকে আমেরিকার মতো শক্তিমান মনে করে, তা হলে তো মুশকিল। ভোট হয় মেশিনারিতে। আমরা আমেরিকা।’’

বাবুমাস্টারের ‘মেকানিজ়ম’ নিয়ে দ্বিমত নেই ডান-বাম কোনও পক্ষেই। সঙ্গে অভিযোগ, পঞ্চায়েত ভোটে তার প্রমাণ মিলেছে।

সেই বাবুমাস্টারও মানছেন মেরুকরণ আছে। তবে তাঁর বিশ্বাস, নুসরতকে দাঁড় করিয়ে দলনেত্রী ‘মাস্টারস্ট্রোক’ খেলেছেন। রাতারাতি দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। তবে অন্য একটি আশঙ্কা তাঁর ঘুম ছুটিয়েছে বলে আড়ালে দাবি মাস্টারের ছাত্রদের। যে ‘মেশিনারি’কে তিনি ভরসা করছেন, মেরুকরণের হাওয়ায় তারা কোনও ‘অঘটন’ ঘটাবে না তো?

ফণী না এলেও ফিরতি পথে গুমোটই ছিল বসিরহাটের হাওয়া। তার উপর অকারণে রেল অবরোধ। সেই হাঙ্গামার প্রান্ত ভাগে দুই চাষি। এক জনের মাথায় টুপি, অন্য জনের পৈতে।

ভোট-প্রশ্নে উত্তর এল, ‘‘এ বছর শসার দাম ওঠেনি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন