গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
রানিবাগান মোড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গিয়েছে। যে দিকেই চোখ যায়, শুধুই টোটো আর টোটো। পিঁপড়ের মতো লাইন দিয়ে এঁকেবেঁকে চলেছে। মিনিট দশেক পর অবশেষে চড়লাম শব্দহীন এই বাহনে।
বহরমপুরে বোধয় টোটোই সব থেকে বেশি আমদানি হয়েছে। যাই হোক, গুটি মেরে বসে রয়েছি একপাশে। সহযাত্রীদের মধ্যে দু’জন একটু বয়স্ক। বাকি দু’জনই কলেজ পড়ুয়া। বয়সে তরুণ। চারজনের কথাবার্তা শুনে মনে হলে গোল বেধেছে অনেকক্ষণ আগেই। এখন আলোচনার পারদ মধ্যগগণে।
এই ভোটের বাজারে বহরমপুরে অধীর চৌধুরী ছাড়া আর কী নিয়েই বা আলোচনা হতে পারে! কিন্তু দুই কলেজ পড়ুয়ার কথা শুনে মনে হল, তাঁরা অধীরের বিষয়েও যেমন খোঁজ রেখেছেন। তেমনই এখানে শুভেন্দু অধিকারীর ঘাঁটি গেড়ে পড়ে থাকা, সিপিএম-আরএসপি আলাদা অবস্থান নিয়েও অনেকটা ওয়াকিবহল।
আরও পড়ুন: নির্বাচনী প্রচার ঘিরে বাম-তৃণমূল সংঘর্ষ ডায়মন্ড হারবারে, অশান্তি বীরভূমেও
লালদিঘির আড্ডায়, কালেক্টর মোড়ের চায়ের দোকানে, বহরমপুরের বাসস্ট্যান্ডের সামনে ফলের দোকানেও একই আলোচনা— এ বার অধীর চৌধুরী কি শুভেন্দু-ডেভিড (অপূর্ব সরকার, তিনি তৃণমূল কংগ্রসের বহরমপুরের প্রার্থী, এক সময়ে অধীরের রাজনৈতিক ‘শিষ্য’ ছিলেন) জুটিকে উড়িয়ে দিতে পারবেন? নাকি শুভেন্দুর রণকৌশল তৃণমূল কংগ্রেস অধীরের ভোট বাক্সে থাবা মারবে? বহরমপুরে অধীর হারবেন, এ কথা তৃণমূলের কর্মী সমর্থকেরা ছাড়া আর কেউ বলছেন না। আলোচনার বিষয় একটাই, অধীরের ভোট কি কমবে এবার?
বহরমপুরে খাতায়-কলমে অপূর্ব সরকার বনাম অধীর চৌধুরীর ভোট হলেও, রাজনৈতিক ময়দানে লড়াই কিন্ত অধীর আর শুভেন্দুর মধ্যে। অনেকটা নিজেদের ‘অস্তিত্ব’ প্রমাণ করার লড়াই। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের নায়ক শুভেন্দুকে মুর্শিদাবাদ জেলার পর্যবেক্ষক করেছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পর থেকে তিনি আদা-জল খেয়ে পড়ে রয়েছেন বহরমপুরে। জঙ্গিপুর এবং মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে ভোট শেষ হতেই বহরমপুরই এখন তাঁর অস্থায়ী ঠিকানা।
এই কেন্দ্র থেকে শুভেন্দু ভোটে লড়ারও ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু মমতা ‘ছাড়পত্র’ দেননি। তাই এই আসন কংগ্রেসের কব্জা থেকে বের করে আনাই এখন শুভেন্দুর কাছে চ্যালেঞ্জ।অধীররঞ্জন চৌধুরী নিজের মাটিকে কিন্তু ভালই চেনেন। তিনি নিজস্ব কৌশলেই এগোচ্ছেন। রাত তখন সাড়ে ন’টা। কংগ্রেসের পার্টি অফিসে পৌঁছে গিয়েছি অনেক আগেই। তখনও অধীর চৌধুরীর দেখা নেই। সাধারণত তিনি সারা দিনের প্রচার সেরে এখানে আসেন। এলেনও, তবে এসেই আবার বেশ কয়েকজনের সঙ্গে বৈঠকে বসে পড়লেন। তার পর দেখা মিলল, মুর্শিদাবাদের ‘নবাব’ অধীর চৌধুরীর।
আরও পড়ুন: ভোটে জিততে বিজেপি এখানে টাকা বিলোচ্ছে: মমতা
বহরমপুরের তৃণমূল প্রার্থী অপূর্ব সরকারের সমর্থনে মিছিলে শুভেন্দু অধিকারী। —নিজস্ব চিত্র।
শুভেন্দু অধিকারীকে নিয়ে প্রশ্ন করতেই ছয় মারার ভঙ্গিতে উড়িয়ে দিলেন অধীর। তাঁর জবাব, “কে কোথায় মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছেন, তার কৈফিয়ত আমি কেন দিতে যাব?” ডেভিডের প্রচার নিয়ে প্রশ্নটা সবে মুখ থেকে বেরিয়েছে, তারই মধ্যে ফের ফোনের রিংটোন বেজে উঠল। এ নিয়ে বেশ কয়েকবার হল এমন ঘটনা। ফোন ধরার মুহূর্তেই বললেন, “ভোটের ফলই প্রমাণ হবে কে কাকে হারাবে।”
আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কংগ্রেসের দাপুটে নেতা অধীর। পার্টি অফিসেই চলেছে কর্মীদের নিয়ে রণকৌশলের হিসেবনিকেশ। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফলকে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না অধীর বাহিনী। তা সে যতই বেলডাঙা, কান্দি, ভরতপুর, বড়ঞা, নওদাতে ভাল ফল করুক না কেন তৃণমূল, এ সবের সঙ্গে লোকসভার ভোটের সম্পর্ক নেই বলেই মনে করছে তারা। কংগ্রেস কর্মীদের প্রশ্ন, পঞ্চায়েতে কি ভোট হয়েছিল? এ বার তো শুনছি প্রায় একশো শতাংশ বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকবে। মানুষের সমর্থন তো নেই। তার উপর বাহিনী থাকছে, কী করবে তৃণমূল? হালে পানি পাবে না। গত লোকসভা নির্বাচনে অধীরই রাজ্যের মধ্যে সব থেকে বেশি ভোটের ব্যবধানে জিতে ছিলেন। ভোট পেয়েছিলেন ৫০.৫৪ শতাংশ। ২০০৯-এ পেয়েছিলেন ৫৬.৯১, ২০০৪-এ ৫১.৫০ শতাংশ ভোট। এ বার অধীর নিজের রেকর্ড ভাঙতে পারবেন কিনা, তা সময় বলবে। তবে তিনি মরিয়া নিজেরই রেকর্ড ভাঙতে। দিন-রাত এক করে দিচ্ছেন, ভোটারদের দোরগোড়ায় পৌঁছতে।
এই কেন্দ্রে আলিমুদ্দিনের আপত্তি সত্ত্বেও বামেদের শরিক আরএসপি-র ঈদ মহম্মদ ভোট দাঁড়িয়েছেন। তবে তাঁর পাশে নেই জেলার সিপিএম কর্মী, সমর্থকেরা। তৃণমূলকে হারাতে অধীরের হয়েই ভোট প্রচার করছে সিপিএম। অধীরের ঝুলিতে বামেদের ভোটের ভাল অংশই ঢুকবে। তবে ভোটবাজারে দক্ষিণ দিনাজপুরের কুশমন্ডির বাসিন্দা বিজেপি প্রার্থী কৃষ্ণ জোয়ারদার বহরমপুরের মানুষের মনে দাগই কাটতে পারেননি। অনেকে জানেনই না, এখানে বিজেপি প্রার্থী কে? তাই এখানে লড়াই ত্রিমুখীই।
আরও পড়ুন: দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
এই লড়াইয়ে রাজনৈতিক গুরু অধীর চৌধুরীর সামনে, তাঁরই শিষ্য ডেভিড। অধীরের সৌজন্যে ২০০৬ সালে কান্দির নেতা অতীশ সিংহের বিরুদ্ধে নির্দল প্রতীকে দাঁড়িয়ে জিতেছিলেন ডেভিড। তার আগে অধীর চৌধুরীই ডেভিডকে কান্দি পুরসভার চেয়ারম্যান পদে বসিয়েছিলেন। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোট পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল।কিন্তু তারপর শুরু হয় গুরু-শিষ্যের দ্বন্দ্ব। এখানেই নাকি শুভেন্দুর হাতযশ। অপূর্বের মতোই ২০১৬ সালে কংগ্রেসের টিকিটে জিতেও তৃণমূলে চলে গিয়েছেন বহরমপুর লোকসভার অধীন রেজিনগরের বিধায়ক রবিউল চৌধুরী ও নওদার আবু তাহের খান। তবে বহরমপুর, ভরতপুর, বেলডাঙা এবং বড়ঞা এখনও কংগ্রেসের দখলেই রয়েছে। বহরমপুরে অধীর এগিয়ে থাকলেও, শিষ্য ডেভিড কিন্তু বেগ দিতে তৈরি। তবে বহরমপুরের মানুষ বলছেন এই লড়াই, গুরু-শিষ্যের নয়, এই লড়াই অধীর বনাম শুভেন্দুর।