‘গঙ্গা দেখোনি? এখানেই তো ছিল, কত্ত ঢেউ’

ভোট গঙ্গাএখন গঙ্গা যেখানে বহমান, সেখানে পাড়ের ভাঙন এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, তা নিয়ে আতঙ্কিত বাসিন্দাদের একাংশ। স্টিমার ঘাট হোক কিংবা রবীন্দ্র ঘাট, ভাঙনের জেরে নদীর জলের রং ঘোলা। পাড়ের মাটির বুক কেউ যেন খুবলে নিচ্ছে ক্রমাগত।

Advertisement

দেবাশিস ঘড়াই

শান্তিপুর শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:৫৫
Share:

নীল সাহেবের কুঠি, পিছনেই সুরধনী, তার সামনে দাঁড়িয়ে পুরনো দিনের গঙ্গার কথা বলছেন একাদশী সর্দার। নিজস্ব চিত্র

নদীর ও-পারে পাঁচশো লোকের ঘর ছিল। মড়ক লেগেছিল পরে। লাশ ভেসে থাকত গঙ্গায়।

Advertisement

‘‘গঙ্গা দেখেছ তো বাবা? গঙ্গাই সব লাশ ভাসিয়ে নিয়ে যেত।’’ উঠোনের মধ্যে দাঁড়িয়ে এক নাগাড়ে বলে যাচ্ছিলেন একাদশী সর্দার। নব্বই ছুঁইছুই বয়স। কানে শুনতে পান না। চোখে দেখতে পান না ভাল করে। তাই যাঁদের সঙ্গেই কথা বলেন, আগে তাঁদের বলে নেন, ‘‘বাবা, একটু জোরে কথা বলিস। কানে ভাল শুনি না।’’

কিন্তু কোথায় গঙ্গা? পিছনে তো একটা পুকুর!

Advertisement

একাদশী ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, ‘‘ওটাই তো বাপ সুরধনী গঙ্গা। আগে এমন ছিল নাকি! কত্ত ঢেউ! এক্কেবারে ভাসিয়ে নিয়ে যেত।’’ শান্তিপুরের তিন নম্বর গেট, বানকপাড়ায় একাদশী থাকেন। এখানেই জন্ম। বিয়ে-ঘর-সংসার, সব এখানেই। একাদশী যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন, তার পিছনেই ভগ্নপ্রায় ইটের কাঠামো। এখানকার বাসিন্দারা বলেন, সাহেবদের নীলকুঠি। সাহেবরা থাকত নাকি এখানে। সেই কাঠামোর পিছনেই সুরধনী। একাদশী বলছিলেন, ‘‘দাঙ্গা হয়েছিল। সে-সব দিন তো দ্যাখোনি!’’

নদী বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, কোনও নদী গতিপথ পরিবর্তন করলেও একটি বিন্দুতে (‘নোডাল পয়েন্ট’) সে অপরিবর্তিত থাকে। নবদ্বীপ গাঙ্গেয় বদ্বীপের অন্যতম ‘নোডাল পয়েন্ট’। নবদ্বীপকে অপরিবর্তিত রেখে তার আগে-পরে গঙ্গা একাধিক বার গতিপথ বদলেছে শান্তিপুরে। আর প্রতিটি ক্ষেত্রেই চিহ্ন রেখে গিয়েছে। কখনও তার নাম সুরধনী, কখনও তার নাম হরি নদী। প্রকৃতিগত দিক থেকে সুরধনী হল আদিগঙ্গার মতো। গঙ্গার ছেড়ে আসা এক খাত।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

নদী বিশেষজ্ঞ সুপ্রতিম কর্মকার জানাচ্ছেন, ১৯২২ সালের আগে সুরধনী মূল গঙ্গার উৎসমুখ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তখনও অবশ্য মোহনা থেকে জল ঢুকেছে। মোহনার থেকেও সুরধনী শেষে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় চল্লিশের দশকে। সুপ্রতিম বলছিলেন, ‘‘১৯৪৩ সালের টপোশিট বিশ্লেষণ করে সেই সময়ের গঙ্গার দু’টি ছেড়ে আসা খাতকে চিহ্নিত করা গিয়েছে। একটি হরি নদী, যার নাম তখনকার টপোশিটেও উল্লেখ রয়েছে। আরেকটি হল এই সুরধনী। সুরধনীকে অবশ্য উল্লেখ করা হয়েছিল জলাভূমি হিসেবে।’’

কিন্তু এখন গঙ্গা যেখানে বহমান, সেখানে পাড়ের ভাঙন এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, তা নিয়ে আতঙ্কিত বাসিন্দাদের একাংশ। স্টিমার ঘাট হোক কিংবা রবীন্দ্র ঘাট, ভাঙনের জেরে নদীর জলের রং ঘোলা। পাড়ের মাটির বুক কেউ যেন খুবলে নিচ্ছে ক্রমাগত। বালির বস্তা ফেলে কোনও মতে তা আটকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বটে, কিন্তু গঙ্গার স্রোতের কাছে বস্তার ক্ষমতা আর কতটুকু!

শান্তিপুরে ভাঙনের কবলে গঙ্গার পাড়। নিজস্ব চিত্র

অথচ ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্পের আওতায় ঘাট সংস্কারও গুরুত্বপূর্ণ। শান্তিপুর পুরসভার চেয়ারম্যান অজয় দে বললেন, ‘‘ঘাট যেটুকু সংস্কার হয়েছে, তা পুরসভাই থেকে করেছি আমরা। অতীতে নমামি গঙ্গে প্রকল্পে আমরা প্রস্তাব পাঠালেও তা মঞ্জুর হয়নি। নিকাশি নিয়ে নমামি গঙ্গের ‘গঙ্গা দেখোনি? এখানেই তো ছিল, কত্ত ঢেউ’ সমীক্ষা হলেও ঘাট সংস্কার নিয়ে কোনও পরিকল্পনা নেই। ফলে ভাঙনে শেষ পর্যন্ত কী হবে জানা নেই!’’

তবু মন্দের ভাল, শান্তিপুরে তরল বর্জ্য সরাসরি গঙ্গায় মেশে না। ভাগ্যিস মেশে না! বলছিলেন সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের (সিএসই) সমীক্ষকরা। কারণ, সংস্থার সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী, এ রাজ্যে যে ৫২০ কিলোমিটার (উত্তরপ্রদেশে ১০০০ কিলোমিটারের পরে গঙ্গা সবথেকে বেশি বহমান পশ্চিমবঙ্গেই) যাত্রাপথ জুড়ে গঙ্গা প্রবাহিত হয়েছে, সেখানে এমন একটি শহর বা এলাকা নেই, যেখানে গঙ্গার জল ‘নিরাপদ’! সিএসই-র ‘ওয়াটার অ্যান্ড ওয়েস্টওয়াটার ম্যানেজমেন্ট’-এর সিনিয়র প্রোগ্রাম ডিরেক্টর সুরেশ কুমার রোহিলা বলেন, ‘‘ত্রিবেণী, বহরমপুর, উলুবেরিয়া, দক্ষিণেশ্বর, গার্ডেনরিচ, হাওড়া-সহ পশ্চিমবঙ্গের সব জায়গাতেই গঙ্গার জলে ফিকাল কলিফর্মের মাত্রা নির্ধারিত মাত্রার থেকে কয়েক-কয়েক গুণ বেশি।’’

প্রায় আড়াই যুগ আগে পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গার জলের গুণমান পরীক্ষা করে দেখার জন্য রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের পাশাপাশি ‘ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইন্সস্টিটিউট’-কে (নিরি) নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। তারপর থেকে নির্দিষ্ট সময় অন্তর গঙ্গার জলের মান পরীক্ষা করে দেখেছে নিরি। তাদের রিপোর্টও ধরা পড়েছে এ রাজ্যের গঙ্গার দুরবস্থা! বহু চর্চিত টালি নালা তো রয়েছেই, পাশাপাশি রাজ্যের বিভিন্ন জায়গার প্রায় ৪০টির মতো বড় নিকাশি নালায় দূষণের পরিমাণ কী, সে সমীক্ষা চালিয়েছিল নিরি। নিরির এক বিজ্ঞানীর কথায়, ‘‘বর্জ্য পরিশোধন প্লান্টগুলি অনেক জায়গায় কাজ করে না। বন্ধ থাকে। ফলে দূষণ কমবে কী ভাবে।’’

ন্যাশনাল মিশন ফর ক্লিন গঙ্গা (এনএমসিজি) সূত্রে যদিও খবর, এ মুহূর্তে নমামি গঙ্গের আওতায় রাজ্যে ভাটপাড়া, গয়েশপুর, কল্যাণী-সহ একাধিক প্রকল্প শেষ হয়েছে। কমপক্ষে আরও ১০টি প্রকল্পের কাজ যে কোনও মুহূর্তে শুরু হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের এক কর্তার কথায়, ‘‘২০২০ সালের মধ্যে রাজ্যের অনেক জায়গাতেই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে যাবে।’’

কিন্তু তা দূষণ কমাতে পারবে কি না তা নিয়ে অনেকেরই সংশয় রয়েছে। তার প্রধান কারণ হল গঙ্গাকে নিয়ে তৈরি হওয়া মিথ। গঙ্গার জল পবিত্র, গঙ্গা জলের এই ‘মর্যাদা’ই আসলে তার অভিশাপের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানাচ্ছেন অনেকে। ইতালির অভিযাত্রী আলেক্স বেলিনি গঙ্গা-দূষণ চাক্ষুষ করা এবং সচেতনতা প্রচারের জন্য বারাণসী থেকে কলকাতা পর্যন্ত রোয়িং করেছেন। তিনি বলছেন, ‘‘সকলে এ দেশে গঙ্গাকে পবিত্র মনে করে, অথচ সকলেই নিজের মতো করে গঙ্গা দূষণ করে চলেছে! আমার মতো বিদেশির চোখে বিষয়টি অদ্ভুতই লাগল।’’

অথচ বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের অন্য যে কোনও নদীর তুলনায় ১৫-২০ গুণ দ্রুততার সঙ্গে নিজেকে পরিশোধনের ক্ষমতা রয়েছে গঙ্গার। সুপ্রতিমবাবুর কথায়, ‘‘এই গুণই হল গঙ্গত্ব। কিন্তু ক্রমাগত গঙ্গার পথে বাধা সৃষ্টি করে সেই গুণের হানি ঘটানো হচ্ছে। আমাদের বর্জ্য টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে গঙ্গা!’’

ক্লান্তই বটে! পাঁচটি রাজ্যে ২৫২৫ কিলোমিটারের যাত্রাপথ গঙ্গার। কমপক্ষে ৯৭টি শহর থেকে রোজ প্রায় ২৯৫.৩ কোটি লিটার তরল বর্জ্য সরাসরি গঙ্গায় গিয়ে মিশছে। শুধুমাত্র গঙ্গা তীরবর্তী ১০টি শহরে উৎপন্ন হচ্ছে এই বর্জ্যের ৬৪ শতাংশ। যেখানে-যেখানে পারছে, গঙ্গা সে সব ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আর যেখানে পারছে না, সেখানে নোংরা বর্জ্য, আবর্জনা, শিল্পের দূষণে ক্রমশ স্তিমিত হয়ে আসছে স্রোত। সমীক্ষা এও বলছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে ওই তরল বর্জ্যের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৩৬০.৩ কোটি লিটার!

তবুও এ দেশের মানুষের কাছে ‘গঙ্গা গমনাৎ’—গঙ্গাই গতি! তাই সে গঙ্গা, হোক না সে গঙ্গার ছেড়ে যাওয়া খাত, তাকে যেমন ভুলতে পারেন না নব্বই ছুঁইছুই একাদশী, তেমনই গঙ্গার নির্মল প্রবাহের জন্য অনশনে বসেন স্বামী আত্মবোধানন্দের মতো যুবা সন্ন্যাসীরা।

‘‘এবার যাই বাবা।’’, আস্তে আস্তে ঘরের ভিতর হেঁটে চলে যাচ্ছেন একাদশী। পিছনে পড়ে রইল সুরধনী। পুরনো গঙ্গার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে। দেশভাগের স্মৃতির মতো, দেশভাগের সময়ের হানাহানি, রক্তপাত আর ভেসে যাওয়া লাশেদের স্মৃতির মতো।

স্মৃতির এ দুই মেরুর মাঝামাঝি দাঁড়ানো একাদশীকে কেউ যদি পুরনো দিনের গঙ্গার কথা জিজ্ঞেস করেন, কিশোরীবেলার মতো তিনি বলে ওঠেন, ‘‘গঙ্গা দেখোনি বাবা? গঙ্গা? এখানেই তো ছিল! কত্ত ঢেউ!’’....

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন